img

সাম্প্রতিক সময়ে খোলা বাজারে ডিম ও মুরগির হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধিতে ভোক্তাদের ভোগান্তি বাড়ায় একই সঙ্গে উদ্বেগ ও দুঃখ প্রকাশ করেছে পোলট্রি শিল্পের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি)। এ অনাকাঙ্ক্ষিত মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে ডিমান্ড-সাপ্লাই গ্যাপ ও সুযোগসন্ধানী মধ্যস্বত্বভোগীদের মুনাফা লোটার অপপ্রয়াসকে দায়ী করেছে সংগঠনটি। ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও বিপিআইসিসির সমন্বয়ে শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং তৃণমূল খামারিদের সুরক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার সঠিক বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে বিপিআইসিসি।

চলতি মাসের ১৬ তারিখ বিপিআইসিসির জরুরি বৈঠকে হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানবিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৬ আগস্ট পাইকারি বাজারে মুরগির কেজিপ্রতি দর ছিল ১৩৬ টাকা। বাদামি ডিমের দর ছিল ৯ দশমিক ১০ টাকা ও সাদা ডিমের দর ছিল ৮ দশমিক ৭০ টাকা। কিন্তু ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন ও কেরোসিনের নতুন বর্ধিত দর কার্যকর হওয়ার ঘোষণা এলে বাস-ট্রাক-পিকআপসহ পরিবহন সংকট দেখা দেয়। অনেক মালিক পরিবহন বন্ধ রাখেন, অনেকে আবার অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করেন। যেহেতু ডিম ও মুরগির ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশের জোগান দেয় গ্রামীণ তৃণমূল খামারিরা, তাই পরিবহন সংকটে সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়ায় ঢাকাসহ অন্যান্য জেলা ও বিভাগীয় শহরে ডিম ও মুরগির সরবরাহ কমে যায়, বাড়ে দাম।

 

পরে ১৩ ও ১৪ আগস্ট মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজিতে দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে। পাইকারি পর্যায়ে বাদামি ডিম ১০ দশমিক ৯০ টাকায় এবং ব্রয়লার মুরগির দর ১৭০-১৭৫ টাকায় উঠে আসে। টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের দাম ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা এবং ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিপ্রতি ২০০ টাকায় উন্নীত হয়।

 

এ দাম বাড়ায় সাধারণ খামারিদের কোনো হাত নেই। পরিবহন ব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়ে এলে ১৫ আগস্ট থেকে দাম পুনরায় কমতে শুরু করে। সবশেষ বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) ব্রয়লার মুরগির পাইকারি দাম প্রতি কেজিতে প্রায় ৪০-৪৫ টাকা কমে ১৩০-১৩৫ টাকায় এবং প্রতি একশ বাদামি ডিমের দর ১৩০ টাকা কমে ৯৬০ টাকায় (প্রতিটি ৯ দশমিক ৬০ টাকা) ও সাদা ডিম ১৪০ টাকা হ্রাস পেয়ে ৯৫০ টাকায় (প্রতিটি ৯ দশমিক ৫০ টাকা) বিক্রি হয়েছে।
 

বিপিআইসিসি সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, বর্তমান সময়ে এক কেজি ওজনের ব্রয়লার মুরগি উৎপাদনে খামারির খরচ পড়ে ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা এবং ডিমের খরচ ন্যূনতম ৯ দশমিক ৫০ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে ফিড তৈরির কাঁচামালের দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক দরপতন, পণ্য আমদানিতে মাত্রাতিরিক্ত জাহাজ ভাড়া, লোডশেডিং প্রভৃতি কারণে ডিম ও মুরগির মাংসের উৎপাদন খরচ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
 

তবে উদ্বেগের বিষয়টি হচ্ছে, খামারিরা লোকসান গুনলেও মধ্যস্বত্বভোগীরা অন্যায্য মুনাফা লুটছে। ফলে খামারি ও ভোক্তা উভয়েই প্রত্যাশিত প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মসিউর বলেন, গত ৬ আগস্টের আগে খামারিরা ব্রয়লার মুরগি কেজিপ্রতি গড়ে ১২৮-১৩১ টাকায় অর্থাৎ প্রতি কেজিতে ১২-১৪ টাকা লোকসানে বিক্রি করলেও মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভ করেছে কেজিতে ২৭-৩২ টাকা।

তিনি বলেন, বাজার ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীরা থাকবেই, তবে লাভের পরিমাণ যৌক্তিক হতে হবে। প্রান্তিক খামারিরা নায্যমূল্য না পেলে উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। তাই প্রান্তিক খামারিদের সুরক্ষায় সরকারকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। মসিউর বলেন, সরকারের যতগুলো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে, সেখানে মূলত ডেইরি ও মৎস্য খাতই প্রাধান্য পেয়েছে অথচ আমিষের চাহিদা পূরণে ৪০-৫০ শতাংশ অবদানই পোলট্রি খাতের।

   
ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) সভাপতি কাজী জাহিন হাসান বলেন, পোলট্রির সাপ্লাই সাইড দুর্বল হয়ে পড়ছে। কারণ, লোকসানের ভয়ে অনেক খামারি এ পেশা ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি বলেন, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে এক দিন বয়সী সাদা ব্রয়লার বাচ্চার সাপ্তাহিক উৎপাদন যেখানে ছিল ১ কোটি ৮০ লাখের ওপরে, বর্তমানে তা ১ কোটি ৩৫ লাখে নেমে এসেছে।
 

জাহিন বলেন, গত মে মাসে ব্রয়লার বাচ্চা গড়ে ১৬ দশমিক ৬৫ টাকা ও লেয়ার ২০ দশমিক ৭৪ টাকায়, জুন মাসে ব্রয়লার বাচ্চা গড়ে ৮ দশমিক ০৭ টাকা ও লেয়ার ১৩ টাকায়, জুলাই মাসে ব্রয়লার বাচ্চা ১৮ দশমিক ৭১ টাকা ও লেয়ার ১৩ দশমিক ৯৫ টাকায় এবং আগস্টে এ পর্যন্ত ব্রয়লার বাচ্চা গড়ে ২৮ দশমিক ০৬ টাকা ও লেয়ার ৩১ দশমিক ৫৩ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যেখানে গড় উৎপাদন খরচ ১৪০-১৪৫ টাকা। কাজেই দেখা যাচ্ছে, ব্রিডার খামারগুলো লোকসানে বাচ্চা বিক্রি করার পরও খামারিরা বাচ্চা কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন না। এটা উদ্বেগজনক।


ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (এফআইএবি) সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, কোভিড মহামারির ধকল যখন কিছুটা সহনীয় হতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ফিড তৈরির কাঁচামালের দাম হুহু করে বাড়তে থাকে। যেহেতু ফিড তৈরির অত্যাবশ্যকীয় কাঁচামাল ভুট্টা, সয়াবিনসহ অধিকাংশ উপকরণই আমদানিনির্ভর, তাই কাঁচামালের দর বৃদ্ধি ছাড়াও জাহাজ ভাড়া ও ডলারের দর বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচে কোনোভাবেই লাগাম টানা যাচ্ছে না।
 

খালেদ বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়েই একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। খাদ্য রফতানিকারক দেশগুলোও তাদের রফতানি সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে। তাই নিজেদের খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে মনোযোগী হতে হবে। ভর্তুকি দিয়ে হলেও চাষি ও খামারিদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
 

বিপিআইসিসি সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, পোলট্রির ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ও নির্ভরশীলতা বেড়েছে। কারণ, তুলনামূলক কম দামে এ খাতটি উন্নতমানের প্রাণিজ আমিষ সরবরাহ করে আসছে।
 

তিনি বলেন, উৎপাদন খরচ কমিয়ে এনে কীভাবে আরও সাশ্রয়ীমূল্যে ডিম ও মুরগি ভোক্তার কাছে পৌঁছানো যায়, সে চেষ্টাই তারা করছেন। সরকার আন্তরিকভাবেই সহযোগিতা করছে, তবে তা আরও বাড়াতে হবে।
 

মসিউর বলেন, এমন কোনো কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে খামারি ও সরবরাহকারীদের মাঝে আতঙ্ক তৈরি হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই এখন একটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। কাঁচামালের দাম কমলে, ডলারের দর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে পরিস্থিতি আপনাআপনি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।’ এ সংকটকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারসহ সবার সহযোগিতা চান মসিউর।

 

এই বিভাগের আরও খবর