পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিটি বিষয় বিস্ময়, শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্তের তাগিদ
বিশ্বে প্রথমবারের মতো পদ্মা সেতুতেই নজিরবিহীন গভীরতায় পাইলিং, বিস্তৃত এলাকাজুড়ে নদীশাসন আর অভিনব ট্রিপল ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিংয়ের ব্যবহার করা হয়েছে।
তাই খরস্রোতা পদ্মাকে বাগে আনার প্রতিটি অভূতপূর্ব রেকর্ডই প্রকৌশল বিদ্যার পাঠ্যতালিকা ও গবেষণায় স্থান করে নেবে বলে মনে করছেন প্রকৌশলবিদরা। এ গৌরবগাথা স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে সংযোজন করার তাগিদ শিক্ষা বিশেষজ্ঞের।
দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র আর শত বাধা মাড়িয়ে পদ্মার বুকে এখন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে স্বপ্নের সেতু। পদ্মা সেতু শুধু বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নপূরণের স্মারকই নয়, প্রমত্তা এ নদীকে বাগে আনতে প্রকৌশলীদের মোকাবিলা করা বেশ কয়েকটি অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ নতুন বিশ্ব রেকর্ড করেছে। বিশ্বে একমাত্র পদ্মা সেতু নির্মাণেই সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীরে পাইলিং করা হয়েছে। আর রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প থেকে পদ্মা সেতুকে রক্ষা করতে ব্যবহার করা হয়েছে ট্রিপল ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিংয়ের। ১২ হাজার টন সক্ষমতাই এই অভিনব বিয়ারিংয়ের ব্যবহার পদ্মা সেতুতেই প্রথম। জাজিরা প্রান্তে নদীশাসনের মতো বিসৃত এলাকাজুড়ে নদীর শাসনও বিশ্বে নজিরবিহীন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান সময় সংবাদকে বলেন, নদীশাসন ও পাইলিং ড্রাইভিংয়ের ক্ষেত্রে এবং সবচেয়ে বড় কথা এত বড় স্প্যান এবং ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিংয়ের প্যাডের যে কথা বলা হচ্ছে, এ ইনভেশনের ফলে যেটা হয়েছে সবচেয়ে বড় সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে পদ্মা সেতু বানাতে। পদ্মা সেতু যেটি দিতে যাচ্ছে, সেটি হলো রিখটার স্কেলে যদি ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হয় তাহলে সেটির কোনো ক্ষতি হবে না। পাশাপাশি পদ্মা সেতুর তলদেশ থেকে প্রায় যদি ৬৫ মিটার মাটি সরে যায়, যদি একটি চার হাজার টনের জাহাজ এসে ধাক্কাও মারে তারপরও এ পদ্মা সেতু সগৌরবে তার জায়গাতে দাঁড়িয়ে থাকবে।
প্রকৌশলবিদরা বলছেন, গভীরতায় পাইলিং, অভিনব বিয়ারিংয়ের ব্যবহার আর নদীর শাসনে পদ্মা সেতুর রেকর্ড প্রকৌশলবিদ্যায় এক নতুন গবেষণার বিষয়। নদীর বৈশিষ্ট অনুযায়ী সেতু নির্মাণে নানা অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জের সমাধান এবং সেতুর নির্মাণশৈলী বিশ্বের স্বনামধন্য বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যতালিকায় যুক্ত হবে বলে করেন তারা।
অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, পদ্মা সেতুর যে চ্যালেঞ্জ ও চ্যালেঞ্জের সমাধানের যে পথ, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আমি বলতে চায় এক একটি রেকর্ড। এখানে সিরিজ অব রেকর্ড হয়েছে। এটি নিয়ে প্রকৌশল বিদ্যার নতুন অধ্যায় রচিত হয়েছে। এটি নিয়ে আমরা কিন্তু বই রচিত করতে পারি। এই বই শুধু জাতীয় পর্যায়ে না আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বনামধন্য যেসব বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, সেখানে কিন্তু রেফারেন্স বই হিসেবে পড়াতে পারে।
নতুন প্রজন্মকে আত্মবিশ্বাসী করতে নিজস্ব অর্থায়নে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের কীর্তিগাথা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার পাশাপাশি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে শিক্ষাক্রমভুক্ত করার পরামর্শ শিক্ষাক্রম এ বিশেষজ্ঞর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. অহিদুজ্জামান বলেন, আমরা যখন কারিক্যুলাম করি, আমাদের ঐতিহ্য আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের গর্ব, আমাদের অর্জন এগুলো কিন্তু আমরা তুলে ধরি। সে অর্থে আমি অবশ্যই আশা করি যে, পদ্মা সেতু আমাদের কারিক্যুলামে অন্তর্ভুক্ত হবে।
ইতোমধ্যেই মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতিটি ক্লাসের পাঠ্যবইয়ের প্রচ্ছদে পদ্মা সেতু জায়গা করে নিয়েছে জানিয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বলছে, পদ্মা সেতু মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, পদ্মা সেতু যেহেতু আমাদের জাতির জন্য অত্যন্ত গৌরবের বিষয় সেটি অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি নিশ্চিয় আমাদের বিবেচনার মধ্যে আছে।
এ ছাড়া দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক ভাগ্যবদলে পদ্মা সেতুর অবদান নতুন গবেষণার দ্বার উন্মোচন করবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।