img

সাধারণত আগুন লাগলেই আমাদের মাথায় আসে পানির কথা। কিন্তু পানি দিয়ে তো সব আগুন নেভানো যায় না, এমনটাই বলছেন আগুন নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফায়ার সার্ভিস। তারা বলছে, আগুন ধরলে প্রাথমিকভাবে বুঝতে হবে আগুনের ধরন কেমন, তারপর সেই অনুযায়ী আগুন নেভানোর জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।

যে কোনো আগুন ধরতে দাহ্য-বস্তু বা জ্বালানি, অক্সিজেন এবং তাপ লাগে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য এই তিনটি উপকরণের যেকোন একটি সরিয়ে ফেললে আগুন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে এক এক ধরনের আগুন নেভানোর জন্য এক এক ধরনের কৌশল নিতে হয়।


আগুনের পাঁচটি ধরণ রয়েছে। এই পাঁচ ধরণের আগুনের মধ্যে সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে আগুন লাগার কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে রাসায়নিক পদার্থ থেকে সৃষ্ট আগুন। এই আগুন পানি দিয়ে নেভানো যায় না।


ফায়ার সার্ভিস বলছে, রাসায়নিকের মধ্যে নানা রকমের উপাদান রয়েছে। তাই ঘটনাস্থলে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করে পদ্ধতি বের করে সেই আগুন খুব সতর্কতার সঙ্গে নেভাতে হয়। প্রাথমিকভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস এবং কুয়াশা আকারে পানি দিয়ে নেভানো যায় এ আগুন। তবে এক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের সাহায্য নিতে হয়।

সীতাকুন্ডের কন্টেইনার ডিপোতে ঘটে যাওয়া অগ্নিকান্ডে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রাসায়নিক পদার্থ থাকায় এতো বড় বিস্ফোরণ হয় বলেও ধারণা করা হয়। আর রাসায়নিক পদার্থ থেকে সৃষ্ট আগুন যে পানি দিয়ে নেভানো সম্ভব না তা এই অগ্নিকান্ডের পর আবারও আলোচনায় ওঠে এসেছে। 


আসুন জেনে নেই, যে রাসায়নিককে এই বিস্ফোরণের অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে সেই রাসায়নিক হাইড্রোজেন পার অক্সাইড সম্পর্কে।


হাইড্রোজেন পার অক্সাইড কী?


হাইড্রোজনের পার অক্সাইড একটি রাসায়নিক যৌগ যার সংকেত H2O2। বিশুদ্ধ অবস্থায় এটা বর্ণহীন তরল। বিশেষজ্ঞরা হাইড্রোজেন পার অক্সাইডকে বর্ণনা করেন অক্সিডাইজিং এজেন্ট হিসেবে। সাধারণভাবে একে বলা যায় ব্লিচিং এজেন্ট।


সরাসরি হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ব্যবহার বিপজ্জনক। তাই নিরাপত্তাজনিত কারণে সবসময় এর জলীয় দ্রবণ পরিমিত পরিমাণে ব্যবহার করা হয়। এটি নিজে দাহ্য পদার্থ না হলেও আগুন বা দাহ্য পদার্থের আশেপাশে রাখলে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।


কোথায় ব্যবহৃত হয়?


ইন্ডাস্ট্রিয়াল পর্যায়ে এর ব্যবহার থাকায় বাংলাদেশে অনেক কোম্পানি এখন হাইড্রোজেন পার অক্সাইড উৎপাদন করে। ব্লিচিংয়ের জন্য টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি ও ডাইং ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে অ্যাভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিতে বহুল ব্যবহৃত হয় হাইড্রোজেন পার অক্সাইড। লেদার ইন্ডাস্ট্রিতেও এর ব্যবহার রয়েছে। 


এছাড়া বাথরুম পরিষ্কার, কাপড় ধোয়াসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্যেও ব্যবহৃত হয় এটি। নানা কাজে এর ব্যবহার হলেও সঠিকভাবে সঠিক তাপমাত্রায় এটি ব্যবহার না করলে বিপজ্জনক হতে পারে।


হাইড্রোজেন পার অক্সাইড কতটা বিপজ্জনক?


হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের স্ফুটনাঙ্ক পানির তুলনায় ৫০ ডিগ্রি বেশি। সে কারণে বেশি তাপমাত্রায় এটা বিপজ্জনক হতে পারে। এর উচ্চ ঘনত্ব বেশ বিপজ্জনক। এরকম রাসায়নিক যেন চোখ আর ত্বকের সংস্পর্শে না আসে সেজন্য সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। 


এটা ত্বকের ক্ষতি করতে পারে। চোখে জ্বালাপোড়া হতে পারে। সে কারণে চোখ বা ত্বকের সংস্পর্শে আসলে তাড়াতাড়ি পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড প্রবেশ করলে মাথাব্যথা, নাক জ্বলা বা বমিও হতে পারে। অতিরিক্ত হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ফুসফুসেও সমস্যা তৈরি করতে পারে।


বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন এটা শীতল, শুষ্ক, ভালোভাবে বাতাস চলাচল করে এরকম জায়গায় সংরক্ষণ করা উচিত। বিশেষ করে ফ্লেমেবল কেমিক্যাল অর্থাৎ দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে এটা রাখা বিপজ্জনক। দাহ্য পদার্থ থেকে দূরে এটাকে সংরক্ষণ করা উচিত। কারণ কোন দাহ্য পদার্থের কাছে থাকলে বা আগুন লাগার জায়গায় হাইড্রোজেন পার অক্সাইড থাকলে আগুন বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে যেতে পারে ও এতে মারাত্মক আকারে বিস্ফোরণও ঘটতে পারে।


হাইড্রোজেন পার অক্সাইড কীভাবে আগুনের মাত্রা বাড়ায়


হাইড্রোজেন পার অক্সাইড একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিক্যাল। এটা খুব সাবধানে ব্যবহার করতে হয়। এটা রাখার জন্য আলাদা কনটেইনার আছে। পারিপার্শ্বিক অনেকগুলো অবস্থার ওপর নির্ভর করে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বিস্ফোরিত হবে কিনা।


রাসায়নিক সংরক্ষণের বৈশ্বিক নিয়ম 'ম্যাটারিয়াল সেইফটি ডেটাশিট' অনুযায়ী হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রাখতে হবে গ্লাস, স্টেইনলেস স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম অথবা প্লাস্টিক কনটেইনারে। অন্য কোনো ধাতুর সংস্পর্শ পেলে এটা বিক্রিয়া করে। হাইড্রোজেন পার অক্সাইড যেখানে রাখা আছে তার আশেপাশে কী আছে, কতদিন ধরে কীভাবে রাখা আছে- এসব অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করছে এটা কী আচরণ করবে।

তাছাড়া উচ্চ তাপে এটা বিস্ফোরক আচরণ করতে পারে। এটা দাহ্য পদার্থ না হলেও এটা অক্সিডাইজিং এজেন্ট। অর্থাৎ এটা অক্সিডাইজার হিসেবে কাজ করে। আর অক্সিডাইজারে অক্সিজেন বা ফ্লোরিন বা ক্লোরিনের মতো পদার্থ যুক্ত থাকে যা দাহ্য পদার্থের মতো আচরণ করতে পারে। তার মানে হলো পর্যাপ্ত তাপ ও জ্বালানি পেলেই আগুনের তীব্রতা বেড়ে তা বিস্ফোরণও ঘটাতে পারে। আগুন লাগলে আশেপাশে কোন অক্সিডাইজিং এজেন্ট থাকলে সেটা আগুনের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দেয়।


হাইড্রোজেন পার অক্সাইড যেহেতু রাসায়নিক যৌগ সেই কারণে এটি পানির সংস্পর্শে এলে বিস্ফোরক আচরণ করতে পারে। তাই হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের কারণে কোন আগুন লাগলে তা পানি দিয়ে নেভানো উচিত না। এ ধরনের আগুন নেভাতে হয় ফগ সিস্টেমে, ফোম বা ড্রাই পাউডার জাতীয় অগ্নি নির্বাপন যন্ত্র দিয়ে।


সূত্র: বিবিসি

এই বিভাগের আরও খবর