img

স্বাধীনতার আগে-পরে বাংলাদেশের মানুষ সরিষা তেলের ওপর প্রায় নির্ভরশীল ছিল। নিজেদের উৎপাদিত সরিষা তেল দিয়েই রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সব খাবার আয়োজন হতো। কিন্তু নানা কৌশলে দেশে উৎপাদিত সরিষা তেলকেই বিপন্ন করে তোলা হয়েছে। বাজার দখল করেছে প্রথমে সয়াবিন, এরপর পাম তেল।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম যখন আকাশ ছুঁয়েছে, ঠিক সেই সময়েই দেশের মানুষ আবারও ঐতিহ্যবাহী সরিষা তেল খাবারের দিকেই মনোযোগ দিচ্ছে। অনেকটা বাধ্য হয়েই সরিষাতেই ফিরছে দেশের মানুষ। 
স্বাস্থ্যসম্মত হিসেবে অনেকেই যখন সেই সরিষা তেল ব্যবহারে আগ্রহ বাড়াচ্ছে, তখন দেশের বাজারেও সরিষা তেলের দামও চড়ে গেছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর আগে সরিষা তেল বিক্রি হয়েছিল লিটারে ১৮০ টাকা। মার্চে সেই তেল লিটারে ২৪০ টাকা। মে মাসে এসে সেই সরিষা বিক্রি হচ্ছে লিটারে ২৫০-২৮০ টাকা। আর বোতলজাত সরিষা তেল বিক্রি হচ্ছে রাঁধুনি লিটারে ৩৫০ টাকা। 

কিভাবে ব্যবহার কমল সরিষা তেলের
সয়াবিন ও পাম তেল তুলনামূলক স্বস্তা হওয়ায় এবং চাকচিক্যময় প্রচারণায় দেশের মানুষ সরিষা ফেলে এসব তেল গিলতে শুরু করে। বড় শিল্প গ্রুপগুলো হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে গড়ে তোলে সয়াবিন-পাম তেল পরিশোধন কারখানা। এর পর থেকে সরিষার থমকে যাওয়া এবং সয়াবিন-পামের অগ্রযাত্রা শুরু। মূলত সয়াবিন তেলের প্রায় দেড় গুণ দাম বেশি ছিল সরিষার তেলের। অর্থাৎ এক লিটার সরিষার তেল যেখানে ১৮০ টাকা, সেখানে এক লিটার সয়াবিন তেল ছিল ১০০ টাকা। পাম তেল আরো কম ৮৫-৯০ টাকা। দামের পার্থক্যের কারণে নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত সবাই সয়াবিন-পাম তেলের দিকেই ঝুঁকতে থাকে। ফলে নিজেদের তেল নিজেরা ব্যবহারের বদলে আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ে। আর শৌখিন পণ্য হয়ে ওঠে সেই সরিষা তেল। 

এখন কেন ব্যবহার বেড়েছে
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সয়াবিন, সানফ্লাওয়ার তেলবীজের উৎপাদনে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটে। বিশ্বজুড়ে এই তেলবীজ সরবরাহ প্রক্রিয়া চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। বিপাকে পড়ে উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল সবাই। এরই মধ্যে পাম তেলের বড় রপ্তানিকারক ইন্দোনেশিয়া রপ্তানি নিষিদ্ধ করে। এতে করে ভোজ্য তেলের বাজারে দামে রেকর্ড ছুঁয়ে যায়। সেই রেকর্ড দামের তেল দেশে আনতে গিয়ে এখন লিটারে সয়াবিন ১৯৮ টাকায় ছুঁয়ে দেশেও রেকর্ড গড়ে। আর পাম তেলের দর নির্ধারিত হয় লিটারে ১৭২ টাকা। 

সয়াবিন এবং পাম তেলের তুলনায় সরিষা তেলের দামের ব্যবধান যখন মাত্র ৪০ টাকায় নেমে এলো, তখন অনেকেই ঝুঁকল সরিষা তেলের দিকেই। ফলে সেখানেও দাম বেড়ে গেল। এখন সয়াবিনের তুলনায় সরিষা তেলের লিটারে দামের ব্যবধান ৮২ টাকা। আর বোতলজাত সয়াবিনের তুলনায় বোতলজাত সরিষা তেলের দামের পার্থক্য লিটারে ১৫২ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মৌসুমের শুরুতেও প্রতি মণ সরিষার দাম ছিল মানভেদে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত। এখন সেই সরিষা বাজারে বা কৃষক পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায়। মূলত সরিষার দাম বাড়ায় তেলের দামও বেড়েছে। আবার সরিষা কিনে মিলাররাও তেল বিক্রিতে বাড়তি মুনাফা করার চেষ্টা করছেন। এ কারণেও সরিষার তেলের দাম বেড়েছে। 

সরিষা দিয়ে ভোজ্য তেলের জোগান
২০১৮-১৯ মৌসুমে দেশে পাঁচ লাখ সাত হাজার হেক্টর জমিতে উৎপাদিত সরিষার পরিমাণ ছিল সাত লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে পাঁচ লাখ ৮৮ হাজার ৭৩৭ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে। হেক্টরে ১.৩৬ টন গড় ফলন হিসাবে প্রায় আট লাখ টন সরিষা উৎপাদিত হয়েছে। প্রতিবছর ৩.৫ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হলে ২০৩০ সালে দেশে মোট সরিষা উৎপাদিত হবে প্রায় ৪৬ লাখ ৬৩ হাজার মেট্রিক টন, যা থেকে প্রায় ১৬ লাখ ৩২ হাজার মেট্রিক টন তেল পাওয়া যাবে। 

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের উপপ্রকল্প সমন্বয়ক ড. রেজা মোহাম্মদ ইমনের দাবি, দেশের ২২ লাখ হেক্টর পতিত (দুই ফসলের মাঝের) জমিতে যদি বিনাসরিষা-৪ ও বিনাসরিষা-৯ আবাদ করা যায়, তাহলে বছরে ১৭ হাজার কোটি টাকার তেল আমদানি সাশ্রয় করা সম্ভব। 

এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, ‘দেশে ২২ লাখ হেক্টর জমি পতিত আছে (দুই ফসলি জমির মাঝের সময়ের)। আমন আর বোরোর মাঝে যদি আমরা এই পতিত জমি চাষের আওতায় আনতে পারি, তাহলে বছরে তেলের উৎপাদন আট থেকে ১০ লাখ টন বাড়বে। এতে এখন যে ১৭ হাজার কোটি টাকার তেল আমদানি করতে হয়, সেটা আর আমদানি করতে হবে না। এখন থেকে ধারাবাহিক উদ্যোগ নিলে সেটি বাস্তবায়ন সম্ভব। ’

দেশে উৎপাদনের পরিকল্পনা
ভোজ্য তেল চাহিদার যেহেতু ৮০ শতাংশের বেশি আমদানিনির্ভর, তাই আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশে উৎপাদন না বাড়ালে বিপদে পড়তে হবে। এই পরিস্থিতিতে ভোজ্য তেলের আমদানিনির্ভরতা কমানোর কৃষি বিভাগের পরিকল্পনার কথা জানান কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। মন্ত্রী বলেন, ‘সরিষার আবাদ বৃদ্ধির মাধ্যমে ভোজ্য তেলের আমদানির্ভরতা কমাতে কাজ চলছে। আগামী তিন থেকে চার বছরের মধ্যে ভোজ্য তেলের চাহিদার ৪০ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা সম্ভব হবে। ’

বাংলাদেশে ভোজ্য তেলের চাহিদার ৮০ শতাংশই আমদানিনির্ভর। এই তেলের মধ্যে রয়েছে সয়াবিন তেল, পাম অয়েল, সরিষার তেল, সানফ্লাওয়ার অয়েল এবং রাইসব্রান তেল। এর মধ্যে সয়াবিন তেলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি, যার মধ্যে দেশে উৎপাদন শুধু ২০ শতাংশের মতো।

এই বিভাগের আরও খবর