img

রাজধানীর গ্রিন রোডের বাসা থেকে কলেজে যাওয়ার পথে শনিবার (২ এপ্রিল) উত্ত্যক্তের শিকার হন তেজগাঁও কলেজের প্রভাষক ড. লতা সমাদ্দার। পুলিশ কনস্টেবল নাজমুল তারেকের বিরুদ্ধে হেনস্তার অভিযোগ আনেন ওই শিক্ষিকা। ওই শিক্ষিকা অভিযোগ করেন, হেঁটে কলেজে যাওয়ার সময় হঠাৎ করে পাশ থেকে মধ্যবয়সী, লম্বা দাড়িওয়ালা একজন- ‘টিপ পরছোস কেন’ বলেই গালি দেন তাকে। ওই মধ্যবয়সী ব্যক্তির গায়ে ছিল পুলিশের পোশাক। আর উনি যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তা মুখে বলার মতো না।

ঘটনার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদ করেছেন বিভিন্ন অঙ্গনের মানুষরা। চলচ্চিত্র অঙ্গন, সংগীত, ছোট পর্দার তারকারাসহ বিভিন্ন অঙ্গনের পেশাজীবী মানুষরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই টিপ প্রতিবাদের বিষয়টি শুধু থাকেনি সীমাবদ্ধ। ফার্মগেটের ঘটনার প্রতিবাদ হয় সংসদে। সংসদ সদস্য সুবর্ণা মুস্তাফা টিপ পর স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেন। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনিও এর প্রতিবাদ করতে বাদ যাননি। 

ঘটনার একদিন পরেই অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়। ৪ এপ্রিল সোমবার পুলিশের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অভিযোগকারিনীর সাথে বাক বিতণ্ডায় লিপ্ত হওয়ার কথা প্রাথমিকভাবে স্বীকার করায় তাকে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ছাড়াও আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন করা হবে।
 

ঘটনার পরপরই এ টিপ এখন প্রতিবাদের ভাষা। বর্তমানে পুরো দেশ জুড়ে নারী পুরুষ উভয়েই সোশ্যাল মিডিয়ায় টিপ পরে তাদের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। বিশেষ করে টিপ প্রতিবাদ নিয়ে উত্তাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। মন্তব্যে ভাসাচ্ছেন নেটিজেনরা। আসলে এ টিপ কী? আর কেনও পরি আমরা? বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে টিপের সম্পর্কটা আসলে কী? নারীদের টিপের বিষয় কতটা পুরানো।

বাঙালির সংস্কৃতির সাথে টিপের সম্পর্কটা আসলে কী?

হাজার বছর ধরেই বিশ্বের অনেক দেশের নারীদের মধ্যে টিপ পড়ার রীতি চালু রয়েছে। শুধু বাঙালি বা হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেই এই টিপ পড়ার কোনো রীতি। আঠার শতকে টিপের ব্যবহার সাধারণ ছিল। বিশেষ করে ওই সময়ে ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, বার্মা, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া, মৌরিতানিয়া এবং থাইল্যান্ডে টিপের ব্যবহার শুরু হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ডে টিপের প্রচলন বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর চেয়ে বেশি ব্যবহৃত হতে থাকে। সেই সময় থেকে বাঙালি নারীদের সাজে টিপের অবস্থান বেশ শক্ত। টিপের ব্যবহারে কোন উৎসব কিংবা পার্বণের প্রয়োজন পড়ে না। শাড়ি, চুড়ি আর টিপেই যেন পরিপূর্ণ বাঙালি নারীর সাজ। একাল কিংবা সেকালে ঠিক একইরকম আবেদন চলমান আছে টিপের। টিপ উপামহাদেশের ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মৌরিতানিয়া এবং থাইল্যান্ডেও প্রচলিত। সেসব দেশে টিপকে সম্বোধন করা হয় বিন্দি নামে। যার আক্ষরিক অর্থ ফোঁটা। ভারতের প্রাচীন বৈদিক সংস্কিৃতেও টিপের কথা উল্লেখ আছে যা থেকে ধারণা করা হচ্ছে টিপের প্রচলন প্রায় ৫ হাজার বছর ধরে। কখনো সংস্কৃতির নিদর্শন হিসেবে, কখনো নান্দনিক সাজে, কখনো বা ধর্মীয় কারণে সুপ্রাচীনকাল থেকেই কপালে নানা আকৃতির ফোঁটা দিয়ে এসেছে মানুষ।

সাজে পরিপূর্ণতা, বাঙালি নারীর মাধুর্য ফুটে উঠে দুই ভ্রুর মধ্যকার টিপে। কারো কাছে টিপ নিজম্ব স্টাইল ও ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ, কারো কাছে এটি আবার স্বাধীনতার প্রতীক। শাড়ি, চুড়ি, গয়নার সাথে ছোট একটি টিপে চেহারা ফিরে পায় চিরচেনা মায়া। টিপ, তিলক, কুমকুম, বিন্দি দুই ভ্রুর মাঝ বরাবর কপালের এই সংক্ষিপ্ত এবং অপরিহার্য প্রসাধনটুকুর নাম দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আলাদা। হয়তো আবেদনও। নারীদের কপালে টিপ পরা অথবা না পরার পেছনে রয়েছে ধর্মীয় ও সামাজিক নানান ব্যাখ্যা। কিন্তু সেইসব রমণীরা যারা ছোট্ট এক টিপে খুঁজে পান ভালোবাসা, যাদের সাজ একেবারে ফিকে,অসম্পূর্ণ থেকে যায় তাদের কাছে সেসব ব্যাখ্যা অর্থহীন।

টিপকে যে নামেই ডাকা হোক টিপ বা বিন্দি বস্তুটি বিশেষ আদর পেয়েছে শিল্প সাহিত্যেও। কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী ঊষা উথুপ সব সময় শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে কপালে একই ধরনের টিপ পরেন। তার ওপরে লেখা থাকে ‘ক’। যেন তার ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ। সেই ৬০ দশক থেকে নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদার বড় গোল টিপ পরেন। প্রয়াত ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী সবসময়ই বড় গোল কিংবা হাতে আঁকা টিপ পরতেন। সেই তালিকায় আছেন নিশাত মজুমদারও। আর হাতে আকা টিপ যেন নিজেই একধরনের অলংকার। বৈচিত্র্যময় সাজের সাথে টিপের নকশায়ও এসেছে বৈচিত্র্য। সাজপোশাকে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও টিপের চাহিদা, আকর্ষণ কোনটাই কমেনি। সাজ পোশাক অনুযায়ী মেয়েদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে ছোট্ট এক টিপখানি।

আঠার শতকে টিপের ব্যবহার হতো শ্রেণিভিত্তিক। টিপের মাধ্যমে নারী-পুরুষের অবস্থান সম্পর্কে বোঝানো হতো ভারতীয় উপমহাদেশে। জিয়াউল হক ইতিহাসের অলিগলি বইয়ে টিপ প্রসঙ্গে লিখেছেন, কপালে টিপ বাঙালি তথা আধুনিক বাঙালি নারীর প্রত্যাহিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাঙালি নারীদের ক্ষেত্রে কপালে বড় একটি টিপ দেয়া, তার সৌন্দয্য বৃদ্ধি করে।

এই বিভাগের আরও খবর