img

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে সহিংসতায় জড়িত অস্ত্রধারীদের মধ্যে চারজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁরা স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগকর্মী এবং নৌকার প্রর্থীর সমর্থক। অস্ত্র হাতে গণমাধ্যমে ছবি প্রকাশ হলেও গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হননি। এঁরা খাগরিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা।

এঁদের একজন মোহাম্মদ নিশান। তিনি ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মাইজপাড়ার বাসিন্দা ও ছাত্রলীগকর্মী। সামাজিক যোগাযোগ kalerkanthoমাধ্যম ফেসবুকে পাওয়া এক ছবিতে দেখা গেছে, গত সোমবার ভোটে এগিয়ে থাকা নৌকার প্রার্থী আকতার হোসেন তাঁকে ফুলের মালা পরিয়ে দিচ্ছেন। ফেসবুকে পাওয়া আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, দলের মনোনয়ন পাওয়ার পর একজনকে ফুলের মালা পরিয়ে দিচ্ছেন আকতার। তাঁর নাম শওকত। তিনি যুবলীগকর্মী। বাড়ি নতুন চরখাগরিয়া গ্রামে। গতকাল গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে তাঁকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করতে দেখা যায়। 

অস্ত্রধারী আরো দুজনের পরিচয় নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় ব্যক্তিরা। এঁরা হলেন একই ইউনিয়নের মোহাম্মদখালী গ্রামের নাছির উদ্দিন। তিনিও যুবলীগকর্মী। পরিচয় পাওয়া আরেকজন হলেন মোহাম্মদ সাকিব। তিনিও নৌকার প্রার্থীর সমর্থক।        

সাতকানিয়া থানার ওসি আবদুল জলিল কালের কণ্ঠকে বলেন, মঙ্গলবার (গতকাল) সন্ধ্যায় খাগরিয়া থেকে দেশি বন্দুকসহ জসিম উদ্দিন নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে জসিম নির্বাচনী সহিংসতায় জড়িত ছিলেন কি না, সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানাননি তিনি। তিনি বলেন, ‘অস্ত্রধারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। এখনই তাদের পরিচয় প্রকাশ করা হবে না। ’

একই উপজেলার নলুয়া ইউনিয়নে সোমবার এক শিশুকে কুপিয়ে ও বাজালিয়ায় এক যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১০ ইউনিয়নে সহিংসতায় আহত হয় অন্তত ৫০ জন। অস্ত্রবাজি ও হত্যার ঘটনায়  থানায় কোনো মামলাও হয়নি। পুলিশ বলছে, মামলা করার প্রক্রিয়া চলছে। 

সহিংসতার কারণে খাগরিয়া ইউনিয়নের ৯টি কেন্দ্রের মধ্যে দুটির ভোট স্থগিত করা হয়েছে। বাকি সাতটি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আকতার দুই হাজার ১১ ভোটে এগিয়ে রয়েছেন। দুটি কেন্দ্র স্থগিত থাকায় ফল ঘোষণা করা হয়নি। তবে বড় ব্যবধানে এগিয়ে থাকায় নৌকার প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনাই বেশি। 

ভোট চলাকালে সাতকানিয়া উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের ১০টিতেই গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হয়েছে খাগরিয়ায়। এ ছাড়া বাজালিয়া, চরতি, কাঞ্চনা ও সোনাকানিয়াসহ অন্যান্য ইউনিয়নেও অস্ত্র প্রদর্শন ও গুলির ঘটনা ঘটেছে। 

ভোট চলাকালে খাগরিয়ার গণিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র ও ইউপি কার্যালয় কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থী আকতার হোসেন ও জসিম উদ্দিনের সমর্থকদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। চিহ্নিত হয়নি, এমন অস্ত্রধারীদের বহিরাগত বলে দাবি করছেন স্থানীয় ব্যক্তিরা। 

স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, দুই পক্ষই বহিরাগত সন্ত্রাসী এনে কেন্দ্র দখলের চেষ্টা করে। অস্ত্রধারীদের হাতে দেশীয় এলজি দেখা গেছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেন, এগুলো স্থানীয়ভাবে তৈরি অবৈধ অস্ত্র। 

চারজনের পরিচয় : নৌকার প্রার্থী আকতার হোসেনের মালিকানাধীন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট পাইওনিয়ার ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিংয়ের কর্মী নাছির উদ্দিন। তিনি খাগরিয়ার মোহাম্মদখালী গ্রামের জামাল উদ্দিনের ছেলে। আরেকজন সদ্য এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া ছাত্রলীগকর্মী মোহাম্মদ নিশান। সে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মাইজপাড়ার মোহাম্মদ টিপুর ছেলে। অন্য দুজন হলেন মোহাম্মদ শওকত ও মোহাম্মদ সাকিব। নতুন চরখাগরিয়া গ্রামের মৃত মফজল আহমদের ছেলে শওকতের বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক ডাকাতির মামলা রয়েছে। আর সাকিব জোরারকুল এলাকার বাসিন্দা বলে জানা গেছে। 

শওকত কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি অস্ত্র হাতে কেন্দ্র দখল করতে যাইনি। গণমাধ্যমে এডিট করে আমার ছবি বসিয়ে প্রচার করা হয়েছে। ’

শওকতের ফেসবুক আইডিতে গিয়ে দেখা গেছে, আকতার হোসেন নৌকার মনোনয়ন পাওয়ার পর শওকতের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিচ্ছেন। থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০১ সালে রোজি হত্যা মামলার আসামি শওকত এখন জামিনে আছেন। 

অস্ত্রসহ গণমাধ্যমে ছবি আসা নাছির উদ্দিনের বাবা জামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমার ছেলেকে অস্ত্র হাতে দেখা গেছে কি না, জানি না। ’ তিনি ছেলের মোবাইল নম্বর দেবেন বলে ফোন রেখে দেন। কিন্তু নম্বর আর দেননি। 

মোহাম্মদ সাকিব বলেন, ‘আমি অস্ত্র হাতে কেন্দ্রে যাইনি। গণিপাড়া কেন্দ্রে গোলাগুলির সময় আমি নৌকার চেয়ারম্যান প্রার্থী আকতার হোসেনের সঙ্গে মৈশামুড়া কেন্দ্রে ছিলাম। ’

মোহাম্মদ নিশানের সঙ্গে কথা বলা হয়নি। নিশানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক আইডিতে গিয়ে দেখা যায়, নির্বাচন শেষে গত সোমবার রাতে একাধিক ছবি আপলোড করেছেন তিনি। একটি ছবিতে দেখা গেছে, নিশানকে ফুলের মালা পরিয়ে দিচ্ছেন নৌকার প্রার্থী আকতার।   

শওকত ও নিশানের সঙ্গে তাঁর ছবি ও ফুলের মালা পরানোর বিষয়ে জানতে নৌকার চেয়ারম্যান প্রার্থী আকতার হোসেনের সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে বক্তব্যের জন্য সাকিবকে ফোন দিলে তিনি এক পর্যায়ে মোবাইল ফোনটি আকতার হোসেনকে ধরিয়ে দেন। 

আকতার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি নিজ কেন্দ্রে ভোট দিয়ে গণিপাড়া ও ইউপি কার্যালয় কেন্দ্র পরিদর্শন করি। পরে মৈশামুড়া কেন্দ্রে যাই। সেখানে খবর পাই, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জসিম উদ্দিন দুই-তিন হাজার লোক নিয়ে কেন্দ্রে হামলা চালিয়েছেন। সেখানেই গুলি হয়েছে। পরে আমার কর্মী-সমর্থকরা তাদের প্রতিরোধ করেছে। কারো হাতে অস্ত্র ছিল না। ’

নাছির, নিশান, সাকিব ও শওকতের হাতে অস্ত্র দেখা গেছে বলে জানালে তিনি বলেন, ‘ওরা সবাই জসিম উদ্দিনের সমর্থক। ’ তাহলে আপনার সঙ্গে তাদের ছবি কেন—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনী প্রচারের সময় অনেকে এসে ছবি তোলে। এভাবে কেউ এসে ছবি তুললে কী করতে পারি?’

স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী জসিম উদ্দিনের সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে সোমবার গোলাগুলির ঘটনার পর দাবি করেন, ‘অস্ত্রধারীরা সবাই নৌকার প্রার্থীর সমর্থক। ’

নিহতদের দাফন : নির্বাচনী সহিংসতায় বাজালিয়ায় নিহত আবদুস শুক্কুরকে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলায় দাফন করা হয়েছে। দাফনের আগে চট্টগ্রাম মহানগরীর পাঁচলাইশ থানার শুলকবহর এলাকায় জানাজা হয়। তাঁর নামে বোয়ালখালী থানায় ডাকাতির অভিযোগে একটি মামলা রয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। 

নলুয়া ইউনিয়নে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত স্কুলছাত্র তাসিফকে গতকাল বিকেলে গ্রামের বাড়ির করবস্থানে দাফন করা হয়। 

দুই মৃত্যুর ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে কি না জানতে চাইলে সাতকানিয়া থানার ওসি আবদুল জলিল বলেন, স্বজনদের কেউ এখনো থানায় এজহার নিয়ে আসেনি। এলে মামলা নেওয়া হবে। এ ছাড়া অস্ত্রবাজির ঘটনায় মামলা করার প্রক্রিয়া চলছে।

এই বিভাগের আরও খবর