img

বাংলাদেশে ক্রিকেট জুয়ার প্রসার হয়েছে ২০১২ সালে বিপিএল শুরু হওয়ার পর। প্রথম আসরে গ্রুপ পর্বে পয়েন্ট সমান হয়ে গিয়েছিল চট্টগ্রাম কিংস ও বরিশাল বার্নার্সের। গ্রুপের ম্যাচ শেষে বিপিএল পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান গাজী আশরাফ হোসেন লিপু সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, পয়েন্ট সমান হলেও বরিশালকে পেছনে ফেলে সেমিফাইনাল খেলবে চট্টগ্রাম। সেদিন মধ্যরাতে ডাকা বৈঠক শেষে বিপিএল কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দেয়, চট্টগ্রাম নয়, সেমিফাইনাল খেলবে বরিশাল!

পরের দিন চট্টগ্রাম কিংসের পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান এসকিউ গ্রুপের কর্ণধার সামির কাদের চৌধুরী ক্ষোভ উগড়ে দেন সংবাদ সম্মেলনে, ‘বিপিএল জুয়ার আসর হয়ে গেছে। আমার সন্দেহ হচ্ছে, সেই জুয়ার কারণেই হয়তো সেমিফাইনালে খেলানো হচ্ছে বরিশালকে। আমি তিনবার ম্যাচ ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব পেয়েছি। প্রতিবার জানিয়েছি দুর্নীতি দমন বিভাগ ও নিরাপত্তা ইউনিটকে। পাকিস্তানের সন্দেহজনক একজনকে বিসিবি নয়, আমরাই ধরিয়ে দিয়েছি।’

সন্দেহজনক সেই জুয়াড়ির নাম সাজিদ খান। ২০১২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মিরপুর স্টেডিয়াম থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে। সাজিদের মোবাইল ফোনে পাওয়া যায় সেবার চট্টগ্রামে খেলা পাকিস্তানি ক্রিকেটার নাসির জামশেদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর। ম্যাচ চলার সময় খেলোয়াড়দের ড্রেসিংরুমে প্রবেশের জন্য একাধিকবার চেষ্টা করেন তিনি। বিপিএলে কোনো বিদেশি জুয়াড়ির প্রথম গ্রেপ্তারের ঘটনা সেটা।

এরপর ক্রিকেট জুয়ায় গোয়েন্দা জালে আটকা পড়েছে অনেকে। সর্বশেষ এ বছর ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট চলার সময় জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের হসপিটালিটি রুফটপ থেকে আটক করা হয় তিন ভারতীয় জুয়াড়ি সুনীল কুমার, চেতন শর্মা ও সানি ম্যাগুকে। অথচ করোনার কারণে তখন স্টেডিয়ামে দর্শক প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। শুধু সৌজন্য টিকিটে হাতে গোনা কয়েকজনের অনুমতি ছিল মাঠে আসার। সেই কয়েকজনের অন্যতম ছিল ওই ত্রয়ী। জুয়ার জগতের পরিচিত মুখ চেতন শর্মার পাসপোর্টে ভিসা ছিল ২৬টি দেশের। বাংলাদেশেই গত কয়েক বছরে একাধিকবার এসেছেন তিনি। গ্রেপ্তারের কিছুদিন পর জামিন পেয়ে দেশে ফিরে গেছেন তিন জুয়াড়িই।

তখনকার সিএমপি উপকমিশনার মোহাম্মদ মঞ্জুর মোর্শেদ বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এ নিয়ে, ‘সরষের ভেতর ভূত ঢুকে গেছে। আমরা জানতাম যে ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগগুলোতে জুয়া হয়। অথচ টেস্টেও জুয়ার জন্য দর্শকহীন গ্যালারিতে জুয়াড়ি চলে এসেছিল! ওরা কোন স্পন্সরের কাছ থেকে টিকিট পেয়েছে, জানিয়েছে আমাদের। মামলার কারণে নামটা বলতে চাই না।’

বিসিবির ভেন্যু ম্যানেজার ফজলে বারী খান রুবেলের অনায়াস স্বীকারোক্তি, ‘প্রতিটি ম্যাচে কিছু টিকিট প্রশাসন ও স্পন্সরদের দিতে হয়। ওরা কাদের মাধ্যমে টিকিট পেয়েছে, সেটা আমি জানি না।’

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (পশ্চিম) মো. আবদুল ওয়ারিশ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক জুয়াড়িদের গ্রেপ্তার করাটা আমাদের সাফল্যই। তবে বিসিবিকে সৌজন্য টিকিট দেওয়ার বেলায় সতর্ক হতে হবে আরো।’

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরীর কণ্ঠে ভবিষ্যতে সতর্ক থাকার অঙ্গীকার। ‘আমরা ঘটনাটা শুনেছি। আমাদের সিস্টেমে কে কাকে টিকিট দিয়েছে, সেটি ট্র্যাকিংয়ের ব্যবস্থা ছিল না। ভবিষ্যতে বোর্ড এ ব্যাপারে আরো সতর্ক থাকবে। টিকিট ট্র্যাকিংয়ের কাজটা যদিও কঠিন। বিশেষ করে, আস্তে আস্তে গ্যালারি পুরো খুলে দেওয়া হচ্ছে। তখন তো শুধু স্পন্সর নয়, সাধারণ মানুষও টিকিট কিনবে। তবু বলব, গ্যালারিতে জুয়াড়ি প্রবেশ ঠেকাতে নতুন কোনো পন্থা খুঁজে বের করার সর্বোচ্চ চেষ্টা আমরা করব।’

এমন ঘটনা এ বছর শুধু চট্টগ্রামেই ঘটেনি। ২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপের সময় আটক হওয়া আইসিসির কালো তালিকাভুক্ত ভারতীয় জুয়াড়ি অতনু দত্ত ম্যাচ টিকিট পেতেন বিসিবির এক কর্মচারীর কাছ থেকে।

শুধু বিদেশিই নয়, বাংলাদেশের জুয়াড়িরাও বিদেশে বসে নিয়ন্ত্রণ করছে জুয়ার বাজার। এর অন্যতম রাশিয়া। ২০১২ সালে রাশিয়া অন্তর্ভুক্ত হয় আইসিসিতে। সহযোগী সদস্য হয়েছে ২০১৭ সালে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার সরকার কোনো অনুদান দিত না ক্রিকেটে। সেই রাশিয়ায় বসে ক্রিকেট জুয়ার কারবার চালাচ্ছেন তিন বাংলাদেশি—আশিকুর রহমান, আল আমিন ও নাঈম। জুয়ার জগতে নাঈম পরিচিত ‘হাল্ক’ নামে। মোস্টবেট সাইটটি চালাচ্ছেন এই তিনজন।

সিআইডি সূত্র জানায়, মোস্টবেট সাইটটি বাংলাদেশে সক্রিয় হয় গত বছরের জুলাই মাসে। এতে বিডি যুক্ত করে এজেন্ট নিয়োগ দেন রাশিয়ান মালিকরা। গত ১৭ অক্টোবর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে আরিফ হোসেন, রাব্বি হাওলাদার, রিয়াদ হাসান নামের তিন এজেন্টসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের সবার গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে।

গ্রেপ্তার হওয়া আরিফের বড় ভাই আল আমিন রাশিয়ায় পড়াশোনা করতে গিয়ে জড়ান ক্রিকেট জুয়ায়। তাঁর বাংলাদেশের প্রধান এজেন্ট রাব্বি। তাঁদের মোস্টবেট সাইটে হওয়া জুয়ায় হাকিম নামের একটি বিকাশ এজেন্টসহ সাতটি মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট এবং দুজনের পাঁচটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা লেনদেনের প্রমাণ পান গোয়েন্দারা। তাঁদের মাধ্যমে প্রায় ২০ কোটি টাকা রাশিয়ায় পাচারের তথ্যও পেয়েছেন তদন্তকারীরা। এ ছাড়া ক্যামেরার ব্যবসার আড়ালে জুয়ার টাকা হুন্ডির মাধ্যমে রাশিয়ায় পাচারের অভিযোগে গত ৮ ডিসেম্বর সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার গ্রেপ্তার করে ফজলুল হককে। তিনি পুরানা পল্টনের দারুসসালাম আর্কেড মার্কেটে সিমপেক্স করপোরশেননের স্বত্বাধিকরী।

মোস্টবেটের তদন্ত করতে গিয়ে মেহেরপুরে যুবকদের মধ্যে অনলাইন জুয়া ছড়িয়ে পড়ার তথ্য পান সিআইডির কর্মকর্তারা। তাঁরা আরো জানতে পারেন, ওয়ানএক্সবেট নামের আরেকটি সাইটে জুয়ার লেনদেন হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান নগদে। এই চক্রের প্রধান এজেন্ট মাহফুজুর রহমান নবাবকে স্ত্রীসহ ১৩ নভেম্বর কক্সবাজার থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এ ছাড়া ওয়ানএক্সবেট সাইটের বড় এজেন্ট কেরানীগঞ্জের আনিস মোহাম্মাদী। আনিস মোহাম্মাদী বেটিং জগতে বিগম্যান হিসেবে পরিচিত হলেও এখনো তিনি অধরা। ওয়ানএক্সবেট, টাকা০৭, লাক৭৫, টাকা১০০, দুবাই ক্লাব সাইটগুলো তাঁরই।

সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল আহসান মোস্টবেট ও ওয়ানএক্সবেট সাইটের চক্র নিয়ে কৌতুক করে বলেন, “মুন্সীগঞ্জ-মেহেরপুরের রাস্তা দিয়ে রাশিয়ায় যাওয়া যাচ্ছে এখন! ক্রিকেটের সঙ্গে যে দেশের সম্পর্কই নেই, সেখানে টাকা পাচার হচ্ছে মোস্টবেটের কারণে। ওয়ানএক্সবেটের আনিস জুয়ার জগতে পরিচিত ‘দুবাই ক্লাব’ নামে। মোস্টবেট আর ওয়ানএক্সবেটের সঙ্গে বিডি ছাড়াও আরো কিছু বর্ণ যুক্ত করে মিরর সাইট তৈরি করে রাখা হয়েছে। একটি বন্ধ করা হলে আরেকটি সক্রিয় দেখা যায়। তবে বেগ পেলেও চক্রটাকে প্রায়  নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছি আমরা।”

এই বিভাগের আরও খবর