মাঠে ক্রিকেট, বাইরে জুয়া
এউইন মরগান, জস বাটলার, জো রুটরা ইংলিশ ক্রিকেটের পরিচিত মুখ। তাঁদের সঙ্গে কাউন্টি খেলা ফিলিপ সল্টের নাম জানার কথা নয় সাধারণ কোনো বাংলাদেশির। অথচ গত ৬ ডিসেম্বর এই সল্টকে ঘিরে যাত্রাবাড়ীতে মাওয়াগামী বাস কাউন্টারের কাছে এক চায়ের দোকানে বাজি ধরা হয়েছিল প্রায় তিন লাখ টাকা।
লঙ্কা প্রিমিয়ার লীগে কলম্বোয় ডাম্বুলা জায়ান্টসের হয়ে খেলছিলেন ২৫ বছরের ফিলিপ সল্ট। বিপক্ষ দল ক্যান্ডি ওয়ারিয়র্সে ছিলেন বাংলাদেশের পেসার আল আমিন হোসেন। ততক্ষণে ২৬ বলে ৬৪ রানের বিস্ফোরক ইনিংস খেলে ফেলেছেন সল্ট।
আল আমিনের বলে আউট হবেন সল্ট—এটা নিয়ে সেই দোকানে ১২ জন দর্শক বাজি ধরেছেন তিন লাখ টাকার মতো। শেষ পর্যন্ত আল আমিনের বলেই কট অ্যান্ড বোল্ড সল্ট! বাজিতে জেতা জুয়াড়িদের হঠাৎ চিৎকারে সাধারণ পথচারীরাও হকচকিত। তবে তারাও বোঝে, এটা ক্রিকেট জুয়ার হল্লা। গ্রাম-শহরে এমনই সাধারণ ঘটনা হয়ে গেছে ক্রিকেট জুয়া।
শুধু লঙ্কা প্রিমিয়ার লীগই নয়, ওই দোকানটিতে নগদ টাকায় বছরজুড়ে জুয়ার আসর বসে আইপিএল, বিপিএল, বিশ্বকাপ বা জাতীয় দলের ম্যাচ নিয়ে। সারা দেশে এমন দোকান, গ্যারেজ, ক্লাব বা হোটেলের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বলে জানান জুয়ার ঘটনা তদন্তে নিয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, নগদ জুয়ার পাশাপাশি বাজি ধরা হয় নানা ওয়েবসাইটেও। সেখানে জুয়া খেলা সাধারণ রিকশাচালক, ড্রাইভার, হকার, ছাত্র, ব্যবসায়ীদের ক্রিকেটজ্ঞান জেনে অবাক হবেন বোদ্ধারাও। নামি তারকা থেকে অখ্যাত ক্রিকেটারের ব্যাটিং-বোলিং পরিসংখ্যানও মুখস্থ তাদের। কিন্তু টাকার নেশায় বাজি ধরে আঙুল ফুলে কলাগাছ খুব বেশি মানুষ হয়নি। সব হারিয়ে নিঃস্ব হওয়া মানুষের সংখ্যাটাই বেশি।
নিজের মোবাইল, ল্যাপটপ, সঞ্চয়পত্রের পর স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে জুয়া খেলা যাত্রাবাড়ীর এক জুয়াড়ি নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেন কালের কণ্ঠের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এই নেশা সাজানো সংসার শেষ করে দিয়েছে আমার। ভালো ব্যবসা করতাম, এখন পথে বসে গেছি। আমার অনেক বন্ধুও নিঃস্ব হয়ে গেছে। বাচ্চা দুটির মুখ দেখলে এখন নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়।’
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) গত তিন বছরে বন্ধ করেছিল বাজি ধরার ১৭৬টি ওয়েবসাইট। তবে কিছুদিন পর ওয়েবসাইটগুলো ডোমেইনে নাম বদলে ফিরে এসেছে। প্রতিটি ডোমেইনের দাম মাত্র এক হাজার টাকা। মূল সাইটের কাছাকাছি নাম দিয়ে মিরর বা বিকল্প সাইট খুলছে। কিছু অনুমোদনহীন গেটওয়ের মাধ্যমে বন্ধ হওয়া সাইট বা নতুন সাইট ব্রাউজ করেও খেলা হয় জুয়া। সব মিলে এখন চালু আছে প্রায় আড়াই শ সাইট। সাইটগুলোর ডোমেইন দেশের বাইরে। নির্ধারিত সময় পর পর আইপি (ইন্টারনেট প্রটোকল) পরিবর্তন করে নিয়ন্ত্রণকারীরা। ফলে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
বলে বলে বাজি : বাজির নানা স্তর চিহ্নিত করেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। কোন দল হারবে, জিতবে কারা—প্রধান বাজিটা এই নিয়ে হয়। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ম্যাচের আগে দেওয়া হয় রেট। জুয়াড়িরাও দেয় নানা প্রলোভন। ধরা যাক, জিম্বাবুয়ে-অস্ট্রেলিয়া টি-টোয়েন্টি ম্যাচে কোনো ওয়েবসাইট বাজির রেট দিল ৪:১। জিম্বাবুয়ে যেহেতু দুর্বল, তাই তারা জিতলে কেউ এক হাজার টাকা বাজি ধরলে পাবে চার হাজার টাকা। আর অস্ট্রেলিয়া জিতলে এক হাজার টাকা।
পুরো ম্যাচের পাশাপাশি বাজি ধরা হয়, প্রথম ১০ ওভারে কত রান হবে, কোন বোলার কত উইকেট পাবেন বা কোন ব্যাটার ৫০ রান করতে পারবেন কি না—এসব নিয়েও। আবার প্রতি ওভারে কত রান বা উইকেট, এমনকি বলে বলেও বাজি ধরে জুয়াড়িরা। তাতে কোন বলে ৪, ৬, ২, ১ রান হবে নাকি উইকেট যাবে—টাকা খাটানো হয় এসব নিয়ে।
জুয়ার এমন বিস্তারে হতাশ বাংলাদেশের সাবেক ফাস্ট বোলার হাসিবুল হোসেন শান্ত। তিনি বললেন, ‘যুবসমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এই ক্রিকেট জুয়ায়। এটা রুখতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে আরো কঠোর হতে হবে।’
জুয়ার আখড়া : সাধারণ মানুষের জন্য কিছু চায়ের দোকান, সেলুন আর গ্যারেজ হয়ে উঠছে জুয়ার আখড়া। ঢাকায় যাত্রবাড়ী, খিলগাঁও, পুরান ঢাকা, মোহাম্মদপুর, গাবতলী, মিরপুর, উত্তরা—সব জায়গায় আছে এমন জুয়ার আসর। বাজি ধরা হয় টিভিতে বা ফেসবুক, ইউটিউবে খেলা চলার ফাঁকে। দোকানের মালিকের ভূমিকা কখনো মধ্যস্থতাকারীর তো কখনো আসল জুয়াড়ি তিনি নিজেই। জেতা টাকার ১০ থেকে ২০ শতাংশ লাভ দিতে হয় দোকানিকে। এখানেও ওত পেতে থাকে জুয়ায় উৎসাহ দেওয়া লোকজন। এরা মূলত এজেন্ট।
তদন্ত সূত্র বলছে, মধ্য ও উচ্চবিত্তরা যান বিভিন্ন ক্লাব, বার, তিন বা পাঁচতারা মানের হোটেলে। পুলিশি তৎপরতায় ক্রীড়াঙ্গনে ক্যাসিনো বন্ধ হলেও কোনো ক্লাবে জায়ান্ট স্ক্রিন বসিয়ে, কোনো ক্লাবে বড় টিভিতে খেলা দেখানোর ব্যবস্থা করে অনলাইন বেটিংয়ের আয়োজন করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘আমরা মোহামেডান, মুক্তিযোদ্ধা, ওয়ান্ডারার্সসহ ঢাকার ক্লাবপাড়ায় ক্যাসিনো বন্ধ করেছি। তবে ম্যাচ চলার সময় কেউ যদি ক্লাবে বসে গোপনে বাজি ধরে, সেখানে আমরা কী বা করতে পারি। এটা ক্লাব কর্তাদের দেখা উচিত।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমনই বড় ক্লাবের এক শীর্ষ কর্তা বললেন, সাধারণ মানুষের ক্লাবে বসে জুয়া খেলার কথা নয়। তার পরও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে ক্যাসিনো খেলা হয়েছে বছরের পর বছর। এখন ধরন বদলে অনলাইনে ক্রিকেট জুয়া হচ্ছে। সাহায্য করছেন সেই কর্মকর্তারাই। তাতে পকেট ভারী হচ্ছে তাঁদের আর বদনাম হচ্ছে ক্লাবের।
ওয়েবসাইটের বেড়াজালে : ভালো মানের একটি মোবাইল ফোন হলেই জুয়া খেলা সহজ এখন। এ জন্য আছে নানা ওয়েবসাইট। অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তথ্য মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে বেট৩৬৫বিডি সাইটটি। এরপর আছে কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা আনিস মোহাম্মদীর ওয়ানএক্সবেট, টাকা০৭, লাক৭৫, টাকা১০০, দুবাই ক্লাব সাইটগুলো। কিছুদিন আগে শেষ হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এই সাইটগুলোতে প্রতি ম্যাচেই লেনদেন হয়েছে কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়া জুয়া হয় মোস্টবেট, বাইবেট, বিডিবেট১০, স্কাইফেয়ার, গেমঅনসেভেন, বেটনাও২৪, বেটিন১০০, স্কোর৬৬, বেটিন২০, ৬এনবিডি, বেটফাস্ট৩৬৫সহ আরো অনেক সাইটে।
এই ওয়েবসাইটগুলোয় একাধিক বিকাশ, রকেট ও নগদ নম্বর দেওয়া আছে। সেখানে টাকা পাঠালে পাওয়া যায় সমপরিমাণ কয়েন। জুয়ার জন্য প্রয়োজন সর্বনিম্ন ২০ কয়েন। জেতার পর টাকা তুলতে ‘উইথড্র’ অপশনে গিয়ে অনুরোধ পাঠালে নগদ, বিকাশ বা রকেট নম্বর দিলে ৩০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয় লাভের টাকা।
তদন্তকারী সংস্থা বলছে, কয়েন বিক্রির পর বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়ে উধাও হয়েছেন অনেক ওয়েবসাইট পরিচালক। তার পরও জুয়াড়িরা এই ফাঁদে পা দিচ্ছে। ভুক্তভোগী এক জুয়াড়ির আফসোস, ‘উইনার ডটকম ও পেড পাওয়ার ডটকমে কয়েন কিনেছিলাম। শুরুতে ওরা দ্রুত টাকা দিয়ে দিত। কিন্তু আমার জমানো টাকা চার লাখ হওয়ার পর দেখি দুটি সাইটই বন্ধ। কার কাছে অভিযোগ দিব। পুলিশে জানালে তো জুয়াড়ি বলে আগে আমাকেই ধরবে।’
অবৈধ মুদ্রায় লেনদেন : বাংলাদেশে জুয়া যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি অনুমোদন নেই ক্রিপ্টোকারেন্সিরও। কিন্তু দুটিই চলছে সমানতালে। ক্রিকেট জুয়ার ক্ষেত্রে লেনদেনের জন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে শুরু করে ব্যবহার করা হয় পেপাল, মাস্টারকার্ড, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড। রয়েছে বিভিন্ন দেশের অনলাইনভিত্তিক কার্ড ও ক্রিপ্টোকারেন্সি।
সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল আহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সাতরাস্তা থেকে মাহমুদুর রহমান জুয়েল নামের এক জুয়াড়িকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। তিনি বিটকয়েন, ইথিরিয়াম, ইউএসডিটি নামের ডিজিটাল মুদ্রা কেনাবেচা করতেন। জুয়েল বিটকয়েনের কারবার করছিলেন তিনটি অ্যাপের মাধ্যমে।
গত ১৮ এপ্রিল পুলিশের অ্যান্টিটেররিজম ইউনিট চার জুয়াড়িকে গ্রেপ্তারের পর জানতে পারে, ‘স্ট্রিমকার’ নামের একটি অ্যাপের মাধ্যমে পাচার হচ্ছে জুয়ার টাকা। তারা বিন্স ও জেমস নামের দুই ধরনের ডিজিটাল কারেন্সি ব্যবহার করছিল।
এ বিষয়ে কামরুল আহসান বলেন, ‘জুয়া, বিশেষ করে ক্রিকেটের বাজিতে অবৈধ ভার্চুয়াল মুদ্রার লেনদেনের তথ্য আমরা পেয়েছি। তাতে ধারণা করা হচ্ছে, অনলাইন ব্যাংকিং আর হুন্ডির মাধ্যমে বছরে হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার হয়ে যাচ্ছে। একটা সময় জনপ্রিয় ক্রিকেট ওয়েবসাইট ক্রিকইনফোর মাধ্যমে বেটিং৩৬৫ সাইটে বিকাশ, রকেট, নগদ দিয়ে জুয়া খেলা হতো। আমরা বলার পর এই অপশনটি এখন বন্ধ রেখেছে সাইটটি।’
তথ্য, যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও জেনেক্স ইনফোসিসের প্রধান নির্বাহী আবু তৈয়ব জানালেন, বাংলাদেশে যে মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সংস্থাগুলো আছে, তাদের মাধ্যমে নামমাত্র দামে চক্রগুলো জুয়ার চিপস সরবরাহ করছে। আর সাইটগুলোর মূল প্রযুক্তি সহায়তা আসে চীন, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন আর ইউক্রেন থেকে। দেশ ও ক্রিকেটের স্বার্থে কঠোর নজরদারির মাধ্যমে এটা প্রতিরোধ করতে হবে।
অনলাইন জুয়া বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার গতকাল শনিবার রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা এগুলো বন্ধের কার্যক্রম চালু রেখেছি। যেসব সাইট শনাক্ত হচ্ছে তা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ভিপিএনের মাধ্যমে যেসব জুয়ার সাইট চালু আছে বা বন্ধ করা সাইটগুলো আবার ফিরে আসছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে কিছু করার সক্ষমতা আমাদের নেই।’