img

কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে সরকার কতটুকু লাভবান হয়েছে তা জানতে চেয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের প্রকৃত পরিমাণ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে সংস্থাটি।গতকাল রবিবার অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদলের বৈঠকে এসব বিষয়ে আলোচনা হয়।

আইএমএফের উন্নয়নবিষয়ক সহকারী পরিচালক রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে আর্টিক্যাল মিশন-৪ নামে পরিচিত প্রতিনিধিদলটি ১৪ দিনের সফরে গত শুক্রবার বাংলাদেশে আসে। সফরের প্রথম দিনে তারা অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে।

বৈঠকে করোনায় ক্ষতি মোকাবেলায় সরকারঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ, রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি, টিকা আমদানির খরচ, ব্যাংকিং খাতের অতিরিক্ত তারল্য ও এক অঙ্কের সুদহার, অর্থপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে পদক্ষেপ এবং এফএটিএফের সুপারিশ বাস্তবায়ন, মুুদ্রানীতির আধুনিকায়ন, চলমান মুদ্রানীতিসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেন।  

চলতি অর্থবছরের বাজেটে নতুন শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগ, আবাসন, পুঁজিবাজার, ব্যাংকে সঞ্চয় ও নগদ টাকা জমার প্রায় সব খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছে সরকার। এই সুযোগ নিয়ে এ পর্যন্ত কত টাকা সাদা হয়েছে এবং এর বিপরীতে সরকারের রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি কেমন, প্রথম বৈঠকেই তা জানতে চেয়েছে প্রতিনিধিদল।

গতকাল সকাল  সাড়ে ১০টায় অর্থ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অতিরিক্ত সচিব এম কে মজুমদার ও তাঁর দলের সঙ্গে আইএমএফ প্রতিনিধিদলের বৈঠক হয়। বৈঠকে আইএমএফের কর্মকর্তারা জানতে চান, যদি কালো টাকা বেশি সাদা না-ই হয়, তাহলে এই সুযোগ বারবার কেন দেওয়া হয়?

এনবিআরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বিশেষ সুবিধার আওতায় ১১২ কোটি কালো বা অপ্রদর্শিত টাকা সাদা হয়েছে। মাত্র ১৫০ ব্যক্তি এমন সুবিধা নিয়েছেন। এর বিপরীতে সরকার কর পেয়েছে মাত্র ১২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে কালো টাকা বৈধ করার পরিমাণ ছিল ৫৫০ কোটি টাকা। আর গত অর্থবছরের পুরো সময়ে প্রায় ১২ হাজার জন ২০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা সাদা করেন। এ থেকে সরকার কর পেয়েছে দুই হাজার কোটি টাকা।

টিকা আমদানির খরচ নিয়ে আইএমএফ প্রতিনিধিদলকে জানানো হয়, টিকা আমদানিতে প্রায় তিন হাজার ৭০০ মিলিয়ন ডলার খরচ হবে। এর মধ্যে এডিবির কাছ থেকে ৯৪০ মিলিয়ন ডলার, বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার, এআইআইবির কাছ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ও ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের কাছ থেকে ২৫০ মিলিয়ন ইউরোর সমপরিমাণ অর্থের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে বাংলাদেশ।

এ বিষয় জানতে চাইলে বৈঠকে উপস্থিতি অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, কালো টাকা সাদা করা নিয়ে প্রতিনিধিদলটি যেসব তথ্য চেয়েছে, তারা তা সরবরাহ করেছেন। এ ছাড়া করোনা সংকটেও রাজস্ব আদায়ের যে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে সেটি প্রতিনিধিদলকে জানানো হয়েছে।

সকাল সাড়ে ১১টায় বাজেটে অর্থায়ন, কর ও করবহির্ভূত আয়, চলতি ব্যয়, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন, মধ্যমেয়াদি বাজেট প্রস্তুতি, রাজস্ব সংস্কার ও বিদ্যুৎ খাতে সরকারে ভর্তুকি ব্যয় নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে ই খানের সঙ্গে বৈঠক করে প্রতিনিধিদল। এর আগে সকাল সাড়ে ৯টায় সার্বিক অর্থনীতি, প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন ও সরকারের বিভিন্ন নীতি নিয়ে অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে বৈঠক হয়। 

আইএমএফ প্রতিনিধিদলটি দুপুরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকে মহামারি করোনার বিভিন্ন সংকটের মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি তুলে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময় করোনায় ক্ষতি মোকাবেলায় সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের বাস্তবায়ন অগ্রগতিও তুলে ধরা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা ও উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সবুজ অর্থায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরা হয়।

প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন নিয়ে প্রতিনিধিদলকে জানানো হয়, দেশে করোনার আঘাত আসার পর থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং বিভিন্ন খাতের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে মোট ২৮টি প্যাকেজের আওতায় এক লাখ ৩১ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে এক লাখ তিন হাজার ২৫০ কোটি টাকার ৯টি প্যাকেজ বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব প্যাকেজের মধ্যে কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাতে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং বড় শিল্প ও সেবা খাতে ৩৩ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ অন্যতম। এর মধ্যে প্রথম মেয়াদের সিএমএসএমই তহবিল থেকে ৭৭ শতাংশ ঋণ বিতরণ হয়েছে।

বড় শিল্প ও সেবা খাতের প্রথম মেয়াদের ৪০ হাজার কোটি টাকার তহবিলের বাস্তবায়ন হার প্রায় ৮২ শতাংশ। আর প্রথম পর্যায়ে ৯টি প্যাকেজের সার্বিক বাস্তবায়নের হার প্রায় ৮২ শতাংশ। এখন দ্বিতীয় পর্যায়ের প্যাকেজ বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, সার্বিক প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন নিয়ে আইএমএফ সন্তোষ প্রকাশ করে। তবে তাঁরা বড়দের চেয়ে ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণ কম হওয়ার কারণ জানতে চান।

বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তিন ডেপুটি গভর্নরের সঙ্গে ইস্যুভিত্তিক বৈঠক করে আইএমএফ। বৈঠকে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার, ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্য, এক অঙ্কের সুদের হার ও চলমান মুদ্রানীতির বাস্তবায়ন অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত পরিমাণ নিয়ে প্রশ্ন তোলে প্রতিনিধিদলটি। এর জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত রীতি মেনে দীর্ঘদিন ধরে একই পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে রিজার্ভ বেশি দেখানোর কোনো সুযোগ নেই।

আইএমএফের হিসাব অনুসারে, চলতি বছরের জুনের শেষ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৪৬ বিলিয়ন ডলারের যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকার কথা বলা হয়েছিল, তা আসলে ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হবে ৩৯ বিলিয়ন ডলার।

সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সঙ্গে বৈঠক হয় আইএমএফ প্রতিনিধিদলটির। এতে বিএফআইইউর পক্ষে নেতৃত্ব দেন আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটির প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস। বৈঠকে অর্থপাচার ও সন্ত্রাস অর্থায়ন প্রতিরোধে বিএফআইইউর বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হয়।

আর্থিক খাতের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে প্রতিবছরই বাংলাদেশ সফরে আসে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে মাঝের দুই বছর তাদের কোনো সফর ও বৈঠক হয়নি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় এবার আইএমএফ মিশন সফরে আসছে। এর আগে আইএমএফ সর্বশেষ বাংলাদেশ সফর করে ২০১৯ সালে।

এই বিভাগের আরও খবর