img

বড় শক্তিগুলোর ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় জাঁতির (নাট ক্রেকার) মধ্যে আটকা পড়েছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে নাজুক সম্পর্ক এবং এ অঞ্চলে ভারতের ক্রমবর্ধমান ভূমিকার কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

গতকাল রবিবার ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বিশ্ব শান্তি সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের প্যানেল আলোচনায় বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যে এমন পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে।

বেইজিংয়ে সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের পরিচালক ও ওয়ার্ল্ড পিস ফোরামের উপমহাসচিব অধ্যাপক লি লি ভার্চুয়ালি যুক্ত হন এই আলোচনায়। তিনি বলেন, ব্রেক্সিট ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘আমেরিকাই প্রথম’ নীতি বিশ্বের পরিস্থিতিকে খারাপ করেছে। এরপর কভিড মহামারি এই খারাপ পরিস্থিতিকে নাজুক করেছে।

আলোচনা পর্বে ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর বে অব বেঙ্গল স্টাডিজের পরিচালক তারিক এ করিম বলেন, “আমাদের প্রতিবেশী আফগানিস্তান ও মিয়ানমারে চরম সংকট চলছে। বাংলাদেশ বড় দুই শক্তির ‘জাঁতির’ মধ্যে পড়েছে। একটি আঞ্চলিক জাঁতি, আরেকটি বৈশ্বিক।”

অধ্যাপক লি লি বলেন, এই অঞ্চলের অনেক দেশ এখন কোন পক্ষে যাবে, সেই চাপে আছে। এই অঞ্চলের দেশগুলোও কোনো পক্ষ নিতে চায় না।

এই চীনা বিশ্লেষক বলেন, বাংলাদেশ, চীন ও ভারতের মতো দেশগুলো উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমন্বয়কেই প্রাধান্য দিচ্ছে। এর মাধ্যমে ওই দেশগুলো ভূ-রাজনৈতিক কারণে সৃষ্ট উত্তেজনা কাটিয়ে উঠতে পারে। তিনি বলেন, এই দেশগুলোর উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।

উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে গঠিত নিরাপত্তা জোট কোয়াড নিয়ে চীন সতর্কবার্তা দিয়েছে। চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এসে বলেছেন, বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা জোটে যোগ দিলে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হবে। তবে বাংলাদেশ বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা জোটে বাংলাদেশের যোগ দেওয়ার প্রস্তাব এখনো আসেনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত মাসে প্যারিস সফরকালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমনুয়েল ম্যাখোঁর সঙ্গে ইন্দো প্যাসিফিকের নিরাপত্তা বিষয়েও আলোচনা করেছেন। ওই সফরে যৌথ বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এবং সবার জন্য সমৃদ্ধির লক্ষ্যে উন্মুক্ত, অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ ইন্দো প্যাসিফিক গড়ার বিষয়ে উভয় নেতা অভিন্ন মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।

অধ্যাপক লি লি আলোচনায় বলেন, ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবিরোধী কৌশল থেকে সরে এসে পরাশক্তির নতুন প্রতিযোগিতায় নামে। বাইডেন প্রশাসন ট্রাম্প প্রশাসনের সেই নীতিই অনুসরণ করছে। একমাত্র পরিবর্তন এসেছে মিত্রদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আচরণে।

অধ্যাপক লি লি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো প্যাসিফিক কৌশল এই পুরো অঞ্চলকে ভূ-রাজনীতির বৈশ্বিক কেন্দ্রে পরিণত করেছে। বিশেষ করে ভারত নতুন ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় সক্রিয় হচ্ছে। তিনি বলেন, চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক খুব খারাপ পর্যায়ে নেমেছে। এখান থেকে নতুন শীতল যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে।

পরিস্থিতি অস্বাভাবিক নয় : বাংলাদেশ বড় দুই পরাশক্তির ‘জাঁতির’ মধ্যে পড়েছে—এমন পর্যবেক্ষণের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চীন একটি বৈশ্বিক শক্তি এবং আঞ্চলিকভাবে অবশ্যই বড় শক্তি। তাদের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। রাজনৈতিক সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চীন বাংলাদেশের তুলনায় মিয়ানমারকে অনেক অগ্রাধিকার দিয়েছে।’

তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘এর পরও চীন আমাদের এখানে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে। আর তা অস্বাভাবিক নয়। ভারত ভৌগোলিকভাবে আমাদের তিন দিকেই আছে। ভারত নিঃসন্দেহে দক্ষিণ এশিয়ার বড় শক্তি। কাজেই ভারতও একইভাবে চেষ্টা করবে।’

তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আমরা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তির মাঝখানে পড়ে গেছি। যেহেতু আমাদের শক্তি ওই দুই দেশের তুলনায় কম, তাই তারা উভয়েই চেষ্টা করবে আমরা যেন তাদের প্রভাববলয়ে থাকি। আমরা যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছি, দুই পক্ষের সঙ্গেই সম্পর্ক ভালো রাখব, কোনো এক পক্ষের দিকে যাব না; কাজেই এই টানাপড়েন চলতে থাকবে। আর আমরা সাফল্যের সঙ্গে উতরে যেতে পারব।’

এই বিভাগের আরও খবর