img

যেদিন নদীতে ডুবে মরতে বসেছিলেন সেই দিনটার কথা ইউ কংজিয়ানের স্পষ্ট মনে আছে।

চীনের যে কৃষি কমিউনে তার বাড়ি, তার পাশের নদীটি বন্যায় ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। ইউ কংজিয়ানের বয়স তখন ১০ বছর। বন্যার জলধারা দেখতে তিনি দৌড়ে গিয়েছিলেন নদীর পারে। 

কিন্তু হঠাৎ করেই তার পায়ের নিচের মাটির সরে গেল, এক মুহূর্তে তিনি পড়ে গেলেন নদীর পানিতে। তারপর ভেসে যেতে যেতে নদীর পাশের লতাগুল্ম ধরে তিনি প্রাণরক্ষা করতে পেরেছিলেন। উঠে এসেছিলেন নদীর পারে।

"আমার স্থির বিশ্বাস, সেদিনের সেই নদী যদি আজকের মতো হতো, যেখানে নদীর পাড় বাঁধানো রয়েছে কংক্রিট দিয়ে, তাহলে আমি আর জান বাঁচানোর জন্য কোন কিছু খুঁজে পেতাম না," বিবিসিকে বলছিলেন তিনি।

সেদিনের সেই ঘটনা শুধু তার জীবনকেই বদলে দেয়নি, বদলে দিয়েছে চীনের বহু জায়গা।

ইউ কংজিয়ান চীনের সবচেয়ে খ্যাতনামা নগর পরিকল্পনাবিদদের একজন। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেকচার অ্যান্ড ল্যান্ডস্কেপ কলেজের তিনি ডিন।

অধ্যাপক ইউ ছেলেবেলায় এই নদীতেই পড়ে গিয়েছিলেন। ছবিটি ১৯৮৪ সালে তোলা।

অধ্যাপক ইউ ছেলেবেলায় এই নদীতেই পড়ে গিয়েছিলেন। ছবিটি ১৯৮৪ সালে তোলা।

তিনি হচ্ছেন 'স্পঞ্জ সিটি' ধারণার জনক। এই ধারণাকে প্রয়োগ করেই চীনের বহু শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া নদীতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। বন্যার অতিরিক্ত জল শহরগুলোতে নানা উপায়ে ধরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

তিনি মনে করেন, বিশ্বের অন্যান্য শহরেও এই 'স্পঞ্জ সিটি' গড়ে তোলা সম্ভব। যদিও প্রবল বন্যার সময় এই পরিকল্পনা কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে রয়েছে সংশয়।

'জলের সঙ্গে লড়াই নয়'

বন্যাকে ভয় না করে কেন তাকে বরণ করা যায় না?, অধ্যাপক ইউ'র 'স্পঞ্জ সিটি' ধারণার মূল প্রশ্নই এটি।

এখনকার বন্যা নিয়ন্ত্রণে দৃষ্টি দেয়া হয় পাইপ বসিয়ে, ড্রেন তৈরি করে বন্যার জলকে যত দ্রুত সম্ভব পার করে দেয়া। অথবা নদীর দুই কূল কংক্রিট দিয়ে বাধাই করা যাতে বন্যার পানি উপচে না পড়ে।

কিন্তু স্পঞ্জ সিটিতে এর উল্টো কাজ করা হয়। এখানে বন্যার পানিকে স্পঞ্জের মতো শুষে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়, এবং বন্যার স্রোতের গতি কমিয়ে আনা হয়।

তিয়ানজিয়ান শহরের একটি পার্ক। স্পঞ্জ সিটির ধারণাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তোলা এই পার্কটি প্রশংসিত হয়েছে।

তিয়ানজিয়ান শহরের একটি পার্ক। স্পঞ্জ সিটির ধারণাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তোলা এই পার্কটি প্রশংসিত হয়েছে।

এই কাজটা হয় তিন ভাগে। প্রথমত, বন্যার পানি যেখান থেকে আসে। স্পঞ্জের মধ্যে যেমন অনেক ছোট ছোট গর্ত দিয়ে জল শুষে নেয়া হয়, তেমনিভাবে শহরের মধ্যে অনেক জলাশয় তৈরি করে জল ধারণ করা হয়।

দ্বিতীয় কাজটি হলো জলের ধারা নিয়ন্ত্রণ। বন্যার পানিকে লম্বালম্বি লাইন ধরে সরিয়ে না নিয়ে আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে পানিকে প্রবাহিত হতে দেয়া এবং গাছপালা, লতাগুল্ম দিয়ে পানির গতি কমিয়ে আনা।

এর বাড়তি সুবিধে হলো, শহরের মধ্যে অনেক খোলা জায়গা তৈরি হবে, তৈরি হবে পার্ক, বন্য প্রাণীর বসবাসের জায়গা। জলজ লতাগুল্ম বন্যার পানির দূষণ কাটাতেও সাহায্য করবে।

আর তৃতীয় কাজটি হলো বন্যার পানির প্রস্থানের জায়গা, যে পানি, নদী, লেক কিংবা সমুদ্রে গিয়ে পড়বে।

অধ্যাপক ইউ'র পরামর্শ হচ্ছে, নিচু জায়গা থেকে মানব বসতি বা দালানকোঠা সরিয়ে ফেলতে হবে। "বন্যার পানিকে আপনি আটকে রাখতে যাবেন না। একে সরে যাওয়ার পথ করে দিতে হবে," বলছেন তিনি।

অধ্যাপক ইউ'কে বলা হয় চীনের স্পঞ্জ সিটি ধারণার জনক।

অধ্যাপক ইউ'কে বলা হয় চীনের স্পঞ্জ সিটি ধারণার জনক।

সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ড. নির্মল কিশনানি বলছেন, এধরনের পরিকল্পনা বিশ্বের অন্য জায়গাতেও রয়েছে। তবে স্পঞ্জ সিটি শুধু শহরের বন্যা সমস্যা দূর করতে পারে।

"এমুহূর্তে সমস্যা একটা রয়েছে … কিন্তু মোদ্দা কথা হলো আমরা প্রকৃতির অংশ। আর সেই প্রকৃতির কাছাকাছি ফিরে যাওয়ার জন্য আমাদের পথ খুঁজে পেতে হবে।" 

অধ্যাপক ইউ'র মাথায় স্পঞ্জ সিটির ধারণাটি প্রথম আসে পূর্ব চীনের ঝেজিয়াং প্রদেশের উপকূলীয় এলাকায় বেড়ে ওঠার সময়। সেখানে তিনি দেখেছেন চীনের ঐতিহ্যবাহী কৃষি ব্যবস্থা যেখানে পুকুর, ডোবাতে বৃষ্টির জল ধরে রাখা হয়। 

এসবের ওপর ভিত্তি করে তিনি যে পরিকল্পনা তৈরি করেন সেজন্য তার ল্যান্ডস্কেপিং কোম্পানি টুরেনস্কেপ বহু পুরষ্কার জিতেছে। 

"বন্যার জলে কেউ প্রাণ হারাবে না। এমনকি বর্ষার মৌসুমেও। এজন্য শুধু আমাদের শিখতে হবে কীভাবে জলের সাথে সন্ধি করে বেঁচে থাকতে হয়। বন্যা এলে তার সাথে খাপ খাওয়ানো শিখতে হবে," বলছেন তিনি।

হাইকাউ'র মেইশে নদীতে টুরানস্কেপের এই প্রকল্পটি বেশ ক'টি পুরষ্কার পেয়েছে।

হাইকাউ'র মেইশে নদীতে টুরানস্কেপের এই প্রকল্পটি বেশ ক'টি পুরষ্কার পেয়েছে।

সতের-বছর বয়সে ইউ কংজিয়ান বাড়ি ছেড়ে বেইজিং চলে যান। সেখানে তিনি ল্যান্ডস্কেপিংয়ের কাজ শেখেন। একপর্যায়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়াশুনা করেন।

এরপর ১৯৯৭ সালে তিনি যখন চীনে ফিরে আসেন তখন পুরো দেশজুড়ে চলছিল নির্মাণকাজের মহাযজ্ঞ, যেটি এখনও চলছে।

ইট, কাঠ, পাথরের প্রাণহীন জঙ্গল দেখতে দেখতে তিনি স্তম্ভিত হয়ে পড়েন।

এরপর থেকেই অধ্যাপক ইউ চীনা ঐতিহ্য অনুসরণ করে নগর পরিকল্পনার পক্ষে কথা বলতে শুরু করেন।

স্পঞ্জ সিটি ধারণার পাশাপাশি তিনি শহরের মধ্যে গ্রামীণ পরিবেশ তৈরির পরিকল্পনার পক্ষেও যুক্তি তুলে ধরেন।

তিয়ানজিয়ান শহর, স্পঞ্জ সিটি তৈরি হওয়ার আগে।

তিয়ানজিয়ান শহর, স্পঞ্জ সিটি তৈরি হওয়ার আগে।

তার বিশ্বাস, চীনের উপকূলীয় এলাকা এবং অন্যান্য জায়গা যেখানকার প্রকৃতি ও আবহাওয়া একই রকম, সে সব জায়গায় এমনভাবে শহর গড়ে তোলা হচ্ছে যা একেবারেই টেকসই না।

"ইউরোপীয় নগর পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি ডিজাইন কখনই এশিয়ার বর্ষা মৌসুমের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না," বলছেন অধ্যাপক ইউ, "এসব শহর টিকে থাকতে পারে না তার কারণ এগুলো তৈরি করা হয়েছে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি থেকে ধার কার নগর পরিকল্পনাকে নকল করে।"

শুরুর দিকে অধ্যাপক ইউ চীন সরকারের কাছ থেকে নানা রকম বাধা-বিপত্তির মুখে পড়েন। চীনের গর্ব করার মতো বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প থ্রি গর্জেস ড্যামসহ সরকারের নানা প্রকৌশল পরিকল্পনার সমালোচনার জন্য তার প্রতি প্রশাসন বিরক্ত হয়। 

এর পাশাপাশি হার্ভার্ডে তার শিক্ষা ও তার প্রতি পশ্চিমাদেশের প্রশংসা - এসব কারণে লোকে তাকে একজন 'বিশ্বাসঘাতক' এমনকি একজন 'গুপ্তচর' হিসেবে ডাকতে থাকে।

অধ্যাপক ইউ নিজেকে চীনা সংস্কৃতি বিপ্লবের ফসল হিসেবে বর্ণান করেন। সেজন্য তার কাছে এসব অভিযোগ হাস্যকর লাগে।

"আমি পশ্চিমা না, আমি হচ্ছি চীনা ঐতিহ্য-পন্থী," হাসতে হাসতে বলছিলেন তিনি, "আমাদের রয়েছে হাজার বছরে ঐতিহ্য, আমরা যেভাবে সমস্যার সমাধান করি তা আপনিও উপেক্ষা করতে পারবেন না। চীনা ঐতিহ্যকে আমাদের সবসময়ই অনুসরণ করতে হবে।"

স্পঞ্জ সিটির ধারণাটিকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তিনি বুদ্ধিমত্তার সাথে চীনের সরকারি কর্মচারীদের দেশপ্রেমকে উসকে দিয়েছেন। সম্প্রতিকালে বেইজিং এবং উহানে বড় ধরনের বন্যার পর তার পরিকল্পনা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে যেসব প্রচার হয়েছে সেটাও তার উপকারে লেগেছে।

তার পরিকল্পনার প্রতি প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সমর্থনের পর ২০১৫ সালে চীন সরকার একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা ঘোষণা করে। কয়েক লক্ষ ইউয়ান অর্থমূল্যের এই ঘোষণায় বলা হয়: ২০৩০ সালের মধ্যে চীনের সব মিউনিসপ্যাল এলাকার শতকরা ৮০ ভাগে স্পঞ্জ সিটি ধারণা প্রয়োগ করতে হবে এবং বৃষ্টির পানির ৭০ শতাংশ পূনর্ব্যবহার করতে হবে। 

মুশকিল আসান?

সারা বিশ্বে এমন বহু জায়গা রয়েছে যেখানে বর্ষা মৌসুমে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়, বিজ্ঞানীরা যার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করছেন। পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বাতাসের আর্দ্রতাও যায় বেড়ে। ফলে ভারী বৃষ্টিপাত হয়‍।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই সমস্যা ভবিষ্যতে আরও বেড়ে যাবে। আরও বাড়ে যাবে বৃষ্টিপাত।

কিন্তু ঝড়-বন্যা যেসব দেশে বেশি সেখানে কি স্পঞ্জ সিটি বিশেষ কোন কাজে লাগবে?

কোন কোন বিশেষজ্ঞের মতামত হচ্ছে, লাগবে না।

"যেসব জায়গায় হালকা বৃষ্টিপাত বা বন্যা হয় সেখানে স্পঞ্জ সিটির ধারণা কার্যকর বেশি হবে," বলছেন ইউনিভার্সিটি অফ নটিংহ্যাম নাংগবোর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ ফেইথ চান। তিনি বলছেন, "যে ধরনের চরম আবহাওয়া আমরা ইদানিং দেখছি, তাতে বন্যা মোকাবেলার জন্য এখনও আমাদের ড্রেন, পাইপ বা জলাধারের ওপর এখনও নির্ভর করতে হবে।" 

যেসব শহরে জায়গাজমির সঙ্কট রয়েছে যেখানে অধ্যাপক ইউর পরামর্শ অনুযায়ী বন্যার জল ধরে রাখার জন্য খোলা জমি খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

চীনে বন্যা প্রতিরোধে কোটি কোটি ইউয়ান ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও সে দেশে মারাত্মক সব বন্যা হয়।

শুধু গত গ্রীষ্ম মৌসুমেই চীনের বন্যায় প্রাণ হারিয়ে ৩৭৯ জন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এক কোটি ৪৩ লক্ষ মানুষ। আর অর্থনীতিতে প্রায় ২১০০ কোটি ডলারের লোকসান হয়েছে বলে জাতিসংঘের এক হিসেব বলছে।

তবে অধ্যাপক ইউ বলছেন, এসব হয়েছে তার কারণ স্থানীয় পর্যায়ের কর্মকর্তারা, তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল যাদের হাত, তারা স্পঞ্জ সিটির বিষয়টি ধরতেই পারেননি।

এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে ঝেংঝাউয়ের সম্প্রতি বন্যা, বলছেন তিনি, শহরের জলাশয়গুলোর ওপর দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয়েছিল। ফলে যখন বৃষ্টিপাত শুরু হলো তখন উজানে সেই পানি ধরে রাখার কোন ব্যবস্থাই ছিল না। 

আরেকটা বড় প্রশ্ন হলো অন্য কোন দেশে কি স্পঞ্জ সিটি তৈরি করা যাবে?

অধ্যাপক ইউ কংজিয়ান বলছেন, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো বন্য-প্রবণ দেশে এটা সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর এবং রাশিয়ায় একই ধরনের প্রকল্পের বাস্তবায়ন ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে।

তবে স্পঞ্জ সিটির সাফল্য বেশি দেখা যাচ্ছে চীনে। এর পেছনে কারণ হলো সেখানকার কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা আর সরকারের ভাণ্ডারে অঢেল অর্থ। 

অধ্যাপক ইউ বলছেন, যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে স্পঞ্জ সিটি গড়ে তুলতে খরচ পড়বে প্রচলিত ব্যয়ের এক চতুর্থাংশ। তার যুক্তি: উঁচু ভূমিতে বাড়িঘর করে কিছু জায়গা যদি বন্যার জল ধরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে পাইপ, ড্রেন ইত্যাদি নির্মাণে কোন ব্যয় করতে হবে না।

টুরেনস্কেপের অনেকগুলো প্রকল্প এখন চলছে যার লক্ষ্য বন্যা প্রতিরোধী ব্যবস্থাগুলোতে যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলো দূর করা। তিনি বলছেন, যদি গোড়া থেকে স্পঞ্জ সিটির ধারণাগুলো কাজে লাগানো হতো তাহলে কোটি কোটি অর্থ সাশ্রয় হতো।

কংক্রিট ব্যবহার করে বন্যা সামাল দেয়া অনেকটা "তৃষ্ণা মেটাতে বিষ পান করার মতো। এটা একটা অদূরদর্শী কাজ," বলছেন ইউ কংজিয়ান।

 

এই বিভাগের আরও খবর