img

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ১৭টি নথি চুরির ঘটনায় মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের ছয়জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাঁদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে জানিয়ে সংস্থার একাধিক সূত্র বলেছে, এই ঘটনায় মন্ত্রণালয়ের লোকজনই জড়িত।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব মো. আলী নূর সাংবাদিকদের বলেছেন, মন্ত্রণালয়ের কেউ সন্দেহের ঊর্ধ্বে নন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সিআইডি গতকাল রবিবার মন্ত্রণালয় থেকে জোসেফ সরদার, আয়েশা সিদ্দিকা, মিন্টু, বাদল, বারী ও ফয়সালকে তাদের কার্যালয়ে নিয়ে যায়। গত রাত ৮টা পর্যন্ত মালিবাগে সিআইডি কার্যালয়ে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল। তাঁদের মধ্যে জোসেফ সরদার ও আয়েশা কম্পিউটার অপারেটর। অন্যরা তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী।

এই বিভাগের যে কেবিনেটে ফাইলগুলো ছিল সেই কেবিনেটের চাবি জোসেফ ও আয়েশার কাছে থাকে বলে জানা গেছে। ফাইল খোয়া যাওয়ার পর জোসেফ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের জানিয়েছিলেন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত বুধবার অফিস সময়ে ১৭টি নথি একটি ফাইল কেবিনেটে রাখা হয়। পরদিন বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় কাজ করতে গিয়ে দেখা যায় ফাইলগুলো কেবিনেটে নেই।

যে নথিগুলো খোয়া গেছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজসহ অন্যান্য মেডিক্যাল কলেজের কেনাকাটাসংক্রান্ত একাধিক নথি, ইলেকট্রনিক ডাটা ট্র্যাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচি, নিপোর্টের কেনাকাটা, ট্রেনিং স্কুলের যানবাহন বরাদ্দ ও ক্রয়সংক্রান্ত নথি। এর বাইরে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের একাধিক প্রকল্পের নথি খোয়া গেছে।

স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) শাহাদৎ হোসাইনের কক্ষের লাগোয়া কক্ষ থেকে নথিগুলো হারিয়ে যায়। তিনি সচিবালয়ের ৩ নম্বর ভবনের নিচতলার ২৯ নম্বর কক্ষে বসেন। পাশের কক্ষে বসেন ক্রয় ও সংগ্রহ শাখা-২-এর সাঁটমুদ্রাক্ষরিক ও কম্পিউটার অপারেটর মো. জোসেফ সরদার ও আয়েশা সিদ্দিকা। ফাইলগুলো এই দুই কর্মীর কক্ষে ছিল।

এ ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নাদিরা হায়দার শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। ফাইলগুলো ক্রয় শাখার কম্পিউটার অপারেটরের ড্রয়ারে রাখা ছিল বলে জিডিতে উল্লেখ করা হয়।

সিসি ক্যামেরার আওতাভুক্ত এলাকায় খোয়া যায় ফাইলগুলো : বৃহস্পতিবার ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পরপরই সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত শুরু করে। ১৭ নথি খোয়া যাওয়ার জায়গা সিসি টিভি ক্যামেরার আওতাভুক্ত। গতকাল সেই ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে দেখেছেন সিআইডির কর্মকর্তারা। তবে ফুটেজে কাদের দেখা গেছে সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি তাঁরা। এ ছাড়া যে আলমারি থেকে ফাইল খোয়া গেছে, তালায় কার কার হাতের স্পর্শ রয়েছে সেগুলো রাসায়নিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে।

সিআইডির বিশেষ সুপার মো. কামরুজ্জামান গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, কেউ সন্দেহের বাইরে নয়। শুধু এই ছয়জনই নয়, তদন্তের প্রয়োজনে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও এ বিষয়ে কথা বলবেন তাঁরা। শাহবাগ থানার ওসি মওদুত হাওলাদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করতে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে।’

এক পুলিশ কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁরা তদন্তে নেমে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। তাঁরা জানতে পারছেন, ঘটনাটি বাইরের কেউ নয়, মন্ত্রণালয়ের ভেতরের লোকের মাধ্যমেই ঘটেছে। সিআইডির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যে ছয়জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তাঁদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। সেই তথ্য এখন যাছাই করা হবে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, সচিবালয় একটি সংরক্ষিত এলাকা। সেখান থেকে যদি নথি চুরি হয়ে যায়, তাহলে সুরক্ষিত থাকবে কোথায়? তাই কারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন।

নথি গায়েবের ঘটনার পর সচিবালয়ের অন্যান্য মন্ত্রণালয়েও সতর্কতা দেখা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নথি গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি অন্য মন্ত্রণালয়েও প্রভাব ফেলেছে। মৌখিকভাবে সতর্কও করা হয়েছে। হয়তো অফিস আদেশও হবে।

স্বাস্থ্যসচিব যা বললেন : স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব মো. আলী নূর গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘ক্রয়সংক্রান্ত এই ফাইলগুলো তেমন গোপনীয় নয়। প্রতিটা ফাইলের তথ্য আমাদের অন্যান্য বিভাগে আছে, কম্পিউটারে আছে। আমাদের মহাপরিচালকদের (ডিজি) কার্যালয়গুলোতেও আছে। তবে বড় বিষয় হচ্ছে, ফাইল হারিয়ে যাওয়াটা।’

নথি গায়েবের ঘটনায় মন্ত্রণালয়ের কাউকে সন্দেহ করেন কি না জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘সন্দেহের বিষয়টা তো এখন বলা কঠিন। কারণ, আমরা তো সত্যিকারভাবেই জানি না কে এই কাজটি করেছে। আমি তো মনে করি, আমরা সবাই সন্দেহের মধ্যেই আছি। আমরা পুলিশকে সেভাবেই বলেছি, আপনারা সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করবেন, যাতে আমরা তথ্যটা জানতে পারি, উদ্ধার করতে পারি।’

আলোচনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় : মন্ত্রণালয়ের ক্রয় ও সংগ্রহ শাখা থেকে এক মাস আগেও একটি ফাইল হারিয়েছে। সেই ফাইলটিও আয়েশার দায়িত্বে ছিল। এর জন্য তাঁকে শোকজ করা হয়েছিল। মাতৃত্বজনিত অসুস্থতার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে তখন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এই মন্ত্রণালয়ের একাধিক দুর্নীতি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর হয়। এর মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর নমুনা পরীক্ষা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য বিভাগের সাবেক ডিজি আবুল কালাম আজাদসহ ছয়জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সমালোচনার মুখে আবুল কালাম আজাদ পদত্যাগ করেন।

তদন্ত কমিটি গঠন : নথি খোয়া যাওয়ার ঘটনায় শনিবার অতিরিক্ত সচিব শাহ আলমকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন যুগ্ম সচিব (চিকিৎসা শিক্ষা, অতিরিক্ত দায়িত্ব ক্রয় ও সংগ্রহ অধিশাখা) মো. আহসান কবীর ও উপসচিব (চিকিৎসা শিক্ষা-১) মোহাম্মদ আবদুল কাদের। তদন্ত কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

কমিটির প্রধান শাহ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তদন্ত কমিটি কাজ করছে। যাঁরা ওই কক্ষে ছিলেন তাঁদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।’

এই বিভাগের আরও খবর