সোনালী আঁশের দিন কি আবার ফিরে আসছে?
ফরিদপুরের একজন কৃষক হারুন-অর-রশীদ গত বছর পর্যন্ত যে জমিতে ধান চাষ করেছেন, এই বছর সেখানে পাট লাগিয়েছিলেন।
জুলাই মাসে সেই পাট তোলার পর প্রতি মণ বিক্রি করেছেন তিন হাজার ২০০ টাকা করে।
''গত বছর পাট বিক্রি করে অনেকে লাভ করেছে দেখে এইবার আমিও লাগাইছি। দুই বিঘা জমিতে চাষ করেছিলাম, বিক্রি করে ভালো লাভ হইছে। অনেক বছর পর আবার আমরার জমিতে পাট চাষ হইল,'' বলছিলেন মি. রশীদ।
বাংলাদেশের যত জমিতে পাট চাষ হয়, তার এক তৃতীয়াংশ হয় বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায়। তবে মন্দার কারণে কৃষকরা পাট চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু গত বছর থেকে ভালো দাম পাওয়ার কারণে আবার পাটের চাষের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন কৃষকরা।
বেড়েছে পাটের চাষাবাদ
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এই বছর সাড়ে আট লক্ষ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে কম-বেশি ৯০ লাখ বেল (১৮২ কেজিতে এক বেল)।
প্রতি বিঘায় গড়ে নয় মণ পাট চাষ হয়েছে। বেশিরভাগ স্থানে প্রতি মণ পাট বিক্রি হয়েছে তিন হাজার টাকার ওপরে।
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে ৭ দশমিক শূন্য ৮ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছিল। সেই বছর মোট উৎপাদন হয়েছিল ১৫ দশমিক ২৬ লাখ মেট্রিক টন। সেই হিসাবে এই বছর উৎপাদন দাঁড়াতে যাচ্ছে প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ মেট্রিক টন।
চালের চেয়েও দাম বেশি পাটের
বাজারে এই বছর চালের দাম গত তিনবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছেছে। বর্তমানে চালের দাম অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সেই দামকেও টেক্কা দিয়েছে পাট। বাজারে যেখানে এক মণ মোটা চালের দাম ১৬০০ থেকে ২০০০ টাকার মধ্যে রয়েছে, সেখানে ভরা মৌসুমে এক মণ পাটের দাম তিন হাজার টাকার ওপরে।
এই বছরের শুরুর দিকে মজুদ পাটের দাম ছয় হাজার টাকার ওপরে বিক্রি হয়েছে।
যে কারণে বাড়ছে পাটের চাহিদা
বাংলাদেশের পাট গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোঃ আইয়ুব খান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, সারা বিশ্বে এখন প্লাস্টিক বা সিনথেটিক ফাইবার বাদ দিয়ে ন্যাচারাল ফাইবারের একটা ডিমান্ড তৈরি হয়েছে। নানা ধরণের পণ্য তৈরি হচ্ছে।
''বাংলাদেশে এই খাতে অনেক প্রাইভেট সেক্টর তৈরি হয়েছে, বিনিয়োগ হয়েছে, যারা পাট দিয়ে পণ্য তৈরি করে বিদেশে রপ্তানি করছে। ফলে এই খাতে একটা প্রতিযোগিতার বাজার তৈরি হয়েছে। তারা কৃষকের কাছ থেকে বেশি দামে পাট কিনছে। তাই পাটের চাহিদাও বাড়ছে, দামও বেড়েছে।''
ভালো দাম পাওয়ার কারণে কৃষকরাও পাট চাষের প্রতি আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে বলে তিনি জানান।
তিনি জানান, গত বছরের আগে পাটের সর্বোচ্চ মূল্য উঠেছিল আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। কিন্তু গত বছর সর্বোচ্চ ছয়-সাত হাজার টাকা দরেও পাটের মণ বিক্রি হয়েছে।
পাট খাতের সাথে সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, প্রতিবেশী ভারতেও পাটের বড় একটি বাজার রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে কাঁচা পাট রপ্তানির পাশাপাশি অবৈধ পথেও পাট পাচার হয়ে যায় বলে তারা বলছেন।
পাটজাত পণ্য রপ্তানিকারক ইসরাত জাহান চৌধুরী বলছেন, পাটের এত দাম বৃদ্ধির একটা কারণ একটা অসাধু মহল পাট মজুত করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। আরেকটা কারণ হলো আমাদের পাশের দেশে 'আনঅফিসিয়াল'ভাবে বেশ কিছু পাট চলে গেছে। যে কারণে আড়াই হাজার টাকার পাটের মণ ছয় হাজার টাকায় পৌঁছেছে।''
বাংলাদেশে উৎপাদিত এসব পাটের কাঁচামাল ভারতেই সবচেয়ে বেশি রফতানি হয় এবং বিদেশি ক্রেতারা এই পণ্যগুলো ভারতের কাছ থেকে কিনে থাকে।
পাট দিয়ে এখন কী তৈরি করা হচ্ছে?
বাংলাদেশে পাট দিয়ে পাট সূতা, দড়ি, বস্তা, প্যাকিং সরঞ্জাম, ব্যাগ বা থলে, হাতে বাছাই করা আঁশ, পাটজাত কাপড় বহুদিন ধরে তৈরি হয়।
এখন সেই সঙ্গে পাটের তৈরি বৈচিত্র্যময় পণ্যের রপ্তানিও বেড়েছে। পাটের তৈরি টব, খেলনা, জুট ডেনিম, জুয়েলারি, ম্যাটস, নারী-পুরুষের জুতা স্যান্ডেল, বাস্কেট, পাটের শাড়ি, পাঞ্জাবি ও পাটের তৈরি গৃহস্থালি নানা সরঞ্জামের বিদেশে চাহিদা তৈরি হয়েছে। প্রধানত আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলোয় এই জাতীয় পণ্য রপ্তানি করা হয়।
আফ্রিকান দেশগুলো বস্তা ও পাটজাত দড়ি বেশি রপ্তানি হয়।
পাটের আঁশের পাশাপাশি পাটখড়িরও একটি বড় বাজার তৈরি হয়েছে বলে তিনি জানান। এসব পণ্য দিয়ে পার্টিকেল বোর্ড, কম্পোজিট, সেলুলয়েডে ব্যবহার হয়।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, এক যুগের রেকর্ড ভেঙ্গে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে ১১৬.১৪ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে।
আগের বছরের তুলনায় গত বছর পাটজাত পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ৩১ শতাংশ।
বেসরকারি খাত পাট পণ্য তৈরি ও রপ্তানি করলেও রাষ্ট্রায়ত্ত ২৬টি পাটকল লোকসানের কারণে গত বছরের পহেলা জুলাই থেকে বন্ধ রয়েছে।
নানা ধরণের পাটপণ্য তৈরি করছেন এক নারী।
দাম বৃদ্ধি নিয়ে শঙ্কায় মিল মালিকরা
গত বছর পাটের দাম বৃদ্ধির পর রপ্তানিকারকরা ছয় হাজার টাকা মণের বেশি দরে পাট কিনেছেন।
তাতে হারুন-অর-রশীদের মতো অনেক কৃষক এই বছর আরও বেশি জমিতে পাট চাষে আগ্রহী হয়েছেন।
তবে রপ্তানিকারকদের আশংকা পাটের দাম এরকম বেশি থাকলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
বাংলাদেশের জুট গুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক ইসরাত জাহান চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ''পাটের বেশি দাম বৃদ্ধির কারণে আমাদের প্রোডাক্টের দাম বাড়াতে হয়েছে, কিন্তু রপ্তানি ভলিউম বাড়েনি। ফলে তারা সুইচ করে অন্য প্রোডাক্টে চলে যাচ্ছে। দামটা এরকম ওঠানামা করলে ভালোর চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে।''
তিনি বলছেন, পাটের দাম একটি স্থিতাবস্থায় বেধে দেয়া সম্ভব হলে কৃষক ও ব্যবসায়ী- উভয়েই লাভবান হবে।
গত মাসে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একটি বৈঠকে ভারতে যাতে পাট পাচার বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে তারা অনুরোধ করেছেন বলে তিনি জানিয়েছেন।