img

মাছের স্বাদে দেওয়ানা হয়ে একসময় আরব দেশের পরিব্রাজকরা ইলিশের নাম দিয়েছিলেন ‘মালেকুচ্ছম্মা’, যার অর্থ ‘মাছের রাজা’। স্বাদের সুনাম ধরে রেখে বাংলার জাতীয় মাছ ইলিশ বিশ্বজুড়ে এখনো ছড়াচ্ছে দ্যুতি। বিশ্বে উৎপাদিত ইলিশের ৮৬ শতাংশের বেশি মেলে বাংলাদেশের নদ-নদীতে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে বাংলাদেশের ইলিশ ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বর্ষা মৌসুম এলেই বছর বছর ডিম ছাড়তে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ চলে আসে নদীর মোহনায়। এ সুযোগে জেলেরা ইলিশ ধরতে নামেন নদী থেকে সমুদ্রে। ভরা মৌসুমে ইলিশে ভরে যায় জেলের নৌকা। জেলের মুখে দোল খায় হাসি। তাই বাজারেও সস্তায় মেলে ইলিশ। তবে এবারের ছবি একেবারেই আলাদা। ভরা মৌসুমেও ইলিশের দামে আগুন। এবার যেন ‘মাছের রাজা’ বদলে ‘দামের রাজা’ হয়ে উঠেছে ইলিশ। সস্তায় ইলিশ কেনার আশায় যারা দিন গুনছিল, এবার তাদের ডিপ ফ্রিজ খালিই থাকছে। অন্য বছর ক্রেতারা হালি হালি, ডজন ডজন ইলিশ কিনলেও এবার এখনো অনেকের পাতেই ওঠেনি এক টুকরো ইলিশ!

ইলিশের দাম এবার কেন বেশি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, এবার জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়ছে কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভৌগোলিক ও পরিবেশগত কারণে ইলিশের ঝাঁক সাগরে থাকে। পরিভ্রমণশীল হওয়ায় সব সময় একই স্থানে ইলিশের প্রাচুর্য সমান থাকে না। আবহাওয়াজনিত কারণে এবার কিছুটা দেরিতে শুরু হয়েছে ইলিশের মৌসুম। পূর্ণিমার সময় জোয়ার যখন বেশি থাকে তখন ইলিশ ধরা পড়ে বেশি। তবে এবার জোয়ারের পানির উচ্চতা অন্তত তিন ফুট কম থাকছে। এর সঙ্গে রয়েছে নদীদূষণ ও নাব্যতাসংকট। ফলে জালে মিলছে না ইলিশ। এবার মৎস্যপল্লীগুলোতেও নেই তেমন কর্মচঞ্চল্য। খাঁ খাঁ করছে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ও মাছের আড়তগুলো। ইলিশের আশায় মাঝ সমুদ্রে সারা রাত জাল ফেলে ভোরে অনেকটাই গোমড়া মুখে ফিরছেন জেলেরা।

এদিকে ইলিশের জোগান কম থাকার প্রভাব পড়েছে রাজধানীর বাজারে। গেল বছর এই ভরা মৌসুমে ইলিশের দাম কম থাকলেও এবার দামটা অনেকের নাগালের বাইরে। বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে তেমন ইলিশ নেই। মূলত বাজারে এবার সরবরাহ কম থাকায় ইলিশের দামে আগুন। সরবরাহ না বাড়লে কমবে না দাম।

জানা যায়, জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর—এই তিন মাস ইলিশের ভরা মৌসুম। ভরা মৌসুমেও ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই, বরগুনার পাথরঘাটা, বাগেরহাটের শরণখোলায় সেভাবে ইলিশের বাজার জমে ওঠেনি।

ইলিশের কেমন দরদাম : রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি মাছের আড়তে গিয়ে দেখা যায়, দুই দিন আগের চেয়ে গতকাল মঙ্গলবার বাজারে ইলিশের সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে। সেই আড়তে এক কেজি ২০০ গ্রাম থেকে এক কেজি ৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ২৫০ টাকায়, এক কেজি থেকে এক কেজি ১০০ গ্রাম এক হাজার থেকে এক হাজার ১০০ টাকায়, ৮০০-৯০০ গ্রাম ৭০০-৮০০ টাকায়, ৫০০-৬০০ গ্রাম ৪৮০-৫০০ টাকা এবং ৪০০ গ্রাম ৪০০-৪২০ টাকায়। ছোট ইলিশ পাঁচ-ছয়টিতে এক কেজি ৩০০-৩৫০ টাকা এবং সাত-আটটিতে এক কেজি ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

কারওয়ান বাজার রেললাইন ঘেঁষে গড়ে ওঠা খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায়, পাইকারি বাজার থেকে এখানে ওজনভেদে প্রতি কেজি ইলিশ ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। এক কেজি  ২০০ থেকে এক কেজি ৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি এক হাজার ৩০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকায়, এক কেজি এক হাজার থেকে এক হাজার ১০০ টাকায়, ৮০০-৯০০ গ্রাম ৯০০-৯৫০ টাকায়, ৫০০-৬০০ গ্রাম ৬০০-৬৫০ টাকায়, ৪০০-৫০০ গ্রামের ৫০০-৫৫০ টাকায় এবং পাঁচ-ছয়টিতে এক কেজি ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০০-৪৫০ টাকায়।

এদিকে গতকাল চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে পাইকারি বাজারে দেড় কেজি থেকে এক কেজি ৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি ৯৫০ থেকে এক হাজার টাকা, এক কেজি থেকে এক কেজি ১০০ গ্রাম ৭০০-৭৫০ টাকা, ৫০০ গ্রাম ৩৫০-৪০০ টাকা, পাঁচ-ছয়টিতে এক কেজি হয় এমন ইলিশ ১৫০-২০০ টাকায় পাইকারি বিক্রি হয়েছে।

চাঁদপুর বড় স্টেশন পাইকারি বাজারে এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ১২৫ টাকা, এক কেজির নিচে ৮০০ গ্রামের বেশি প্রতি কেজি ৮২৫-৮৫০, ৬০০-৮০০ গ্রাম ৫০০-৫২৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

পাথরঘাটায় পাইকারি বাজারে এক কেজি ২০০ গ্রাম থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি এক হাজার ৫০ থেকে এক হাজার ৮২ টাকায়, এক কেজির নিচে ৯০০-৭০০ গ্রাম ওজনের প্রতি কেজি ৬৮৯-৬৭১ টাকায়, ৫০০-৬০০ গ্রাম ওজনের প্রতি কেজি ৫১৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

সুপারশপেও দাম বেশি : এদিকে গত শুক্রবার রাজধানীর সুপারশপগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, স্বপ্ন ৫০০ গ্রাম ওজনের প্রতি পিস ইলিশ ৩৬৫ টাকা এবং ৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি পিস ৬৬৮ টাকায় বিক্রি করছে। মীনাবাজারে এক কেজি থেকে এক কেজি ১.১৯৯ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি এক হাজার ৪৭৫ টাকায় বিক্রি করছে। আগোরায় ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি পিস ৩৭৯ টাকায় এবং এক কেজি ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি এক হাজার ১৯৯ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

ক্রেতা-বিক্রেতারা কী বলছেন : কারওয়ান বাজার রেললাইন ঘেঁষে গড়ে ওঠা পাইকারি মাছের বাজারের সামনের ফুটপাতে ৩০-৩৫ জন বিক্রেতা ডালায় ইলিশ সাজিয়ে বসে আছেন। কিন্তু দাম বেশি থাকায় ক্রেতাদের আনাগোনা নেই খুব একটা। যে দু-একজন কিনছেন, প্রত্যেকেই চড়া দামে ইলিশ কিনে বাড়ি ফিরছেন। আবার অনেকে দাম শুনেই কপালে ভাঁজ ফেলছেন।

ক্রেতা আল মামুন বলেন, ‘কারওয়ান বাজারে এসেছিলাম কম দামে ইলিশ কিনতে। কিন্তু এখানেই যে দাম চায় তা শুনে দরদাম করার সাহস পাচ্ছি না। এত দাম দিয়ে আমাদের মতো স্বল্প আয়ের মানুষের ইলিশ খাওয়ার সাধ্য নেই। ইলিশ খাওয়াটা জরুরি কিছুও না যে এত দাম দিয়েই খেতেই হবে।’

খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে এবার ইলিশ মাছ খুব কম আসছে, তাই আড়ত থেকেই বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। দাম চড়া থাকায় মানুষ এবার ইলিশ কম কিনছে। দাম কম থাকায় গেল বছর সব আকারের ইলিশ হালি হিসেবে বিক্রি করেছি, এবার দাম বেশির কারণে কেজি হিসেবে বিক্রি করতে হচ্ছে।

কারওয়ান বাজারের ৯ নম্বর আড়তের আড়তদার আব্দুর রহমান সবুজ বলেন, ‘এখন ইলিশের ভরপুর সিজন। কিন্তু নদীতে মাছ কম, তাই বাজার গরম। তবে দুই দিন আগের চেয়ে বাজারে ইলিশের সরবরাহ কিছটা বেড়েছে। তাই সব সাইজের ইলিশের দামও আজ (গতকাল) কিছুটা কম। এখন বরিশাল থেকেই বেশি ইলিশ বাজারে আসছে। ইলিশের বাজারটা হচ্ছে—সরবরাহ বেশি থাকলে দাম কমে যায়, আবার সরবরাহ কমে গেলে দাম বেড়ে যায়। বাজারে গতবারের মতো ইলিশ থাকলে প্রতি কেজিতে ১৫০-৩০০ টাকা পর্যন্ত দাম কম থাকত।’

পাইকারি বাজারের ৪১ নম্বর আড়তদার মো. আলাল বলেন, ‘এবার ইলিশের আমদানি খুবই কম, তাই দাম বেশি। দাম বেশি থাকলেও ইলিশের চাহিদা আছে।’

কারওয়ান বাজারের খুচরা বিক্রেতা বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘বাজারে দাম বাড়তি থাকার কারণে ক্রেতা ইলিশ কম কিনছে। গত বছর এই সিজনে প্রতিদিন চার-পাঁচ মণ ইলিশ বিক্রি করা যেত। এ বছর এখন পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ দেড় মণের মতো ইলিশ বিক্রি করতেই কষ্ট হচ্ছে।’

জেলেপল্লীতে হাহাকার : ইলিশের প্রজনন মৌসুম ঘিরে গেল ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। নিষেধাজ্ঞা শেষে এখন জাল ফেলে ইলিশ পাচ্ছেন না জেলেরা। সাগরে যাওয়া-আসার তেল খরচের টাকাও উঠছে না অনেকের। মৌসুমের শুরুতে নৌকা, জাল কেনা ও মেরামতের জন্য ধারদেনাসহ স্থানীয় পর্যায়ে ঋণ করেন জেলেরা। মৌসুম এলে চার-পাঁচ মাস ইলিশ শিকার করেন। দেনা ও কিস্তির ঋণ পরিশোধ করেন মাছ বিক্রির আয় দিয়ে। বাকি টাকায় সংসার চলে। এবার ইলিশ না পাওয়ায় পরিবার নিয়ে দুর্বিষহ দিন কাটছে তাঁদের।

ইলিশের দেখা মিলছে না এবার সাগরেও। একরকম খালি ট্রলার নিয়ে ফিরছেন জেলেরা। মৌসুমের পাঁচ মাস পার হলেও এ পর্যন্ত লাভের মুখ দেখেননি কোনো মহাজন। সাগর থেকে উঠে আসার পর সবার চোখে-মুখে দেখা যাচ্ছে হতাশার ছাপ। এক ট্রিপে দুই লাখ টাকা বিনিয়োগ করে একটি ইলিশও জালে ধরা পড়েনি, এমন ট্রলারও রয়েছে। কেউ কেউ পুঁজি হারিয়ে সাগরে ট্রলার পাঠাতে পারছেন না বলেও জানা গেছে। একেকটি ট্রলার সাগরে পাঠাতে খরচ হয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। মাছ না মেলায় তেল খরচও ওঠেনি অনেক মহাজনের।

শরণখোলা মৎস্য আড়তদার সমিতির সভাপতি মো. দেলোয়ার ফরাজী বলেন, ‘সাগরের যে অবস্থা তাতে জেলে-মহাজনদের এবার ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে রাস্তায় নামা ছাড়া কোনো উপায় নেই। সাগরে কোনো মাছ নেই। একেকজন ট্রলার মালিক ও আড়তদার আট লাখ, ১০ লাখ টাকা করে লোকসানে আছেন। সামনে সাগরে নামার মতো পুঁজিও অনেকের কাছে নেই।’

এই আড়তদার অভিযোগ করেন, ‘ইলিশের ভরা মৌসুমে ৬৫ দিনের অবরোধ থাকায় ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে অবাধে মাছ ধরে নিয়ে গেছে। ভারতীয় জেলেরা সুন্দরবনের দুবলার চর থেকে মাত্র ২০-২৫ নটিক্যাল মাইল দূরত্বে এসে মাছ ধরে নিয়ে যায়। অবরোধের সময় মাছ না ধরলে সেই মাছটা এখন জেলেদের জালে ধরা পড়ত। ফলে দেশীয় জেলেরা এখন লোকসান গুনছে।’

চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনায়ও জেলেদের প্রত্যাশিত ইলিশ মিলছে না। চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমিতি লিমিটেডের সভাপতি আব্দুল বারী মানিক জানান, পাইকারি বাজার বড় স্টেশনে সাগর ও উপকূলে ধরা পড়া ইলিশের চালানই মূল উৎস। তবে স্থানীয় নদীতে যে পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ে তা চাহিদা অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত নয়।

বিশেষজ্ঞদের মুখে আশার কথা : এবার ইলিশ কম ধরা পড়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বরিশাল জেলা মৎস্য দপ্তরের মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) ড. বিমল চন্দ্র দাস বলেন, এ বছর আবহাওয়াজনিত কারণে কিছুটা দেরিতে শুরু হয়েছে ইলিশ মৌসুম। এ কারণে মানুষের চাহিদাটা বেশি থাকায় দামও বেশি। নদ-নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া এবং পরিবেশ বিপর্যয়ও ইলিশ কম ধরা পড়ার কারণ। আর ডিম পাড়ার সময় ছাড়া খুব কম ক্ষেত্রেই নদীতে ইলিশ আসে। বড় আকারের ইলিশের পুষ্টিগুণ কিছুটা বেশি থাকায় উত্সুক মানুষ এটা কেনার জন্য ভিড় করে, ফলে বড় ইলিশের দাম বাড়তি থাকে।

তিনি জোর দিয়ে বলেন, সব কিছু ঠিক থাকলে আশা করছি আগামী সপ্তাহের মধ্যে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়বে এবং দামও সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের চাঁদপুরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক ড. আনিছুর রহমান বলেন, ইলিশ পরিভ্রমণশীল হওয়ায় সব সময় একই স্থানে ইলিশের প্রাচুর্য সমান থাকে না। এ ছাড়া বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইলিশের চলাচলের পথ ও জীবনচক্রে কিছুটা বিঘ্ন ঘটতেও পারে। এ কারণেও জেলের জালে ইলিশ কম আসতে পারে।

এই বিভাগের আরও খবর