img

গত বছরের ২৯ মে নরসিংদীর একটি ঘটনা। করোনার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে মারা যান ফেরদৌসী বেগম (২৭) নামের এক গৃহবধূ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার খাল্লা গ্রামের মালদ্বীপপ্রবাসী আল আমিনের স্ত্রী ফেরদৌসী নরসিংদীর শালিধা মহল্লায় ভাড়া থাকতেন। মৃত্যুর খবরে কোনো স্বজন না যাওয়ায় তাঁর লাশ সারা দিন পড়ে থাকে হাসপাতালে। নরসিংদীর পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদারের নির্দেশে রাতেই লাশ গ্রহণ করেন নরসিংদী মডেল থানার ওসি সৈয়দুজ্জামান। পরদিন সকালে নরসিংদী পৌর কবরস্থানে জানাজা শেষে ফেরদৌসীর লাশ দাফন করে পুলিশ।

kalerkanthoএক বছর পর একই রকম ঘটনা ঘটে গত শুক্রবার ফরিদপুরে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সদর উপজেলার মাচ্চর ইউনিয়নের কৌরপুর গ্রামের বিপ্লব কুমার সাহা (৫৫)। স্ত্রী ও দুই মেয়ে ছাড়া কোনো আত্মীয়-স্বজন এগিয়ে যায়নি বিপ্লবের লাশ সৎকার করতে। পুলিশ সুপার আলিমুজ্জামানের নির্দেশে শনিবার পুলিশ সদস্যরা কৌরপুর গ্রামে গিয়ে লাশের সৎকার সম্পন্ন করেন।

গত শনিবার চট্টগ্রামের একটি ঘটনা। দিনমজুর ওমর ফারুক শান্তর স্ত্রী কুলসুম বেগমের মাতৃত্বকালীন জটিলতা দেখা দেয়। জরুরি হাসপাতালে নেওয়া প্রয়োজন। অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করার মতো টাকাও নেই ফারুকের পকেটে। তিনি জানতেন না এই লকডাউনের মধ্যে কোথায় গেলে পাবেন অ্যাম্বুল্যান্স বা গাড়ি। নিজের বিপদের কথা কোতোয়ালি থানার পুলিশকে জানাতেই মেলে সহায়তা। ওসি নেজাম উদ্দীনের নির্দেশে এসআই আফরোজা চৌধুরী ও কনস্টেবল আনিস থানার গাড়িতে করে প্রসূতি কুলসুম বেগমকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছে দেন।

প্রতিদিনই দেশে এমন অনেক ঘটনা ঘটছে। করোনার অতিমারির সংকটকালে মানবিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে জনগণের পাশে দাঁড়াচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। কখনো রাস্তায় দাঁড়িয়ে কঠোর লাকডাউন বাস্তবায়ন করছে পুলিশ। কখনো সুরক্ষা নিশ্চিত করতে চালাচ্ছে অভিযান। অন্যদিকে খাবারসহ সহায়তা নিয়ে যাচ্ছে হতদরিদ্রদের কাছে। হাসপাতালে রোগীকে পৌঁছে দেওয়া, কোয়ারেন্টিন পালনে সহায়তা করা; চিকিৎসায় সহায়তা করা; করোনায় মারা গেলে জানাজা পড়ানো; কবর খোঁড়া; দাফন সম্পন্ন; আক্রান্তদের পরিবারকে সুরক্ষায় সহায়তা করা; ত্রাণ দেওয়ার কাজে সহায়তা করা; অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা; অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সেবামূলক আচরণের মাধ্যমে পুলিশের যখন ‘জনতার পুলিশ’ হয়ে ওঠার কার্যক্রম জোরদার করা হয়, ঠিক তখনই সার বিশ্বের মতো করোনা হানা দেয় দেশে। জাতির এমন সংকটের সময় পুলিশ বাহিনী তাদের ‘মানবিক আচরণ’ প্রদর্শনের সুযোগ পেয়েছে। তবে এর জন্য চরম মূল্যও দিতে হচ্ছে পুলিশ বাহিনীকে। দেশের কোনো বিভাগ বা সংস্থা হিসেবে পুলিশেরই সবচেয়ে বেশি সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। সর্বশেষ গতকাল পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২৩ হাজার ৮১৪ জন পুলিশ সদস্য। জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে করোনায় প্রাণ উৎসর্গ করেছেন ১০৩ জন। এর পরও কমেনি মনোবল। থেমে থাকেনি সহায়তার হাত। করোনা সংক্রমণের শুরুতে চরম আতঙ্কের মধ্যে মুখে একটি মাস্ক পরেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পুলিশ সদস্যরা। পরবর্তী সময়ে নিজেদের সুরক্ষাব্যবস্থা বাড়িয়ে মানুষের দোরগোড়ায় একইভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।

সুরক্ষাকাজে ব্যস্ত থাকলেও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করে জননিরাপত্তায় একচুল ছাড় দেয়নি পুলিশ। করোনার সময় চিকিৎসার নামে প্রতারণা, সুরক্ষাসামগ্রী নিয়ে প্রতারণা, অনলাইন ব্যবসার নামে প্রতারণা, মাদক কারবার, জঙ্গি, অনলাইন জুয়া, সামাজিক মাধ্যমের অপরাধীচক্র, কিশোর গ্যাংসহ বিভিন্ন অপরাধীচক্রকে গ্রেপ্তার করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি রাখা হয়েছে স্বাভাবিক। অপরাধ পরিসংখ্যানের প্রায় সব বিভাগেই অপরাধ এখন আগের চেয়ে কম।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ গণ্যমাধ্যমকে বলেন, করোনা মোকাবেলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সর্বোচ্চ ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে কাজ করছেন পুলিশ সদস্যরা। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানবতার কাজও করা হচ্ছে। করোনায় পুলিশ সদস্যরাও মারা গেছেন। কিন্তু সেবা প্রদানে পিছপা হয়নি পুলিশ। মাস্ক পরা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে জনগণকে সচেতন করা হচ্ছে। প্রয়োজনে এ ক্ষেত্রে কঠোরও হচ্ছে পুলিশ। বেনজীর আহমেদ দেশবাসীকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘মাস্ক পরার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। নিজে বাঁচুন, পরিবার ও প্রতিবেশীকে বাঁচান।’ তিনি বলেন, করোনায় পুলিশের যে সদস্যরা মারা গেছেন, মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গিয়েই তাঁরা প্রাণ দিয়েছেন। তাঁদের অবদান জাতি ভুলবে না।’

পুলিশ সূত্র জানায়, বর্তমান আইজিপি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই জনগণের কাছে পুলিশের মানবিক সেবা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে আস্থা বাড়াতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মধ্যে অন্যতম সারা দেশে বিট পুলিশিং চালু এবং মাঠ পর্যায়ের পুলিশের আচরণগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিনজনের করোনা শনাক্ত হলে মানুষের মধ্যে দেখা দেয় চরম আতঙ্ক। এ সময় লকডাউন, কোয়ারেন্টিন, মাস্ক পরা, যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ বাস্তবায়নে কাজ করেছে পুলিশ। লাশ দাফন করা, অসহায় মানুষের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণসহ মানবতার হাত বাড়িয়ে দেশের মানুষের প্রশংসাও কুড়িয়েছে পুলিশ।

একইভাবে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ে দায়িত্ব পালন করে চলেছে তারা। তবে এবার নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে সেবা অব্যাহত রাখার বিশেষ উদ্যোগ নেন আইজিপি বেনজীর আহমেদ।  চালু করেন ‘প্যান্ডেমিক পুলিশিং’। প্রণয়ন করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মানের ‘এসওপি’ এবং ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট প্রটোকল’। করোনার ভয় পুলিশকে দায়িত্ব থেকে সরাতে পারেনি। দমাতে পারেনি মনোবল। ২৩ হাজার ৩৪০ জন আক্রান্ত এবং ১০২ জন মারা গেলেও সেবার ব্রত নিয়ে এখনো সক্রিয় পুলিশ সদস্যরা। রাজারবাগে ২৫০ শয্যার কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে এখন ৭৫০ শয্যার কভিড হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়েছে। যারা কভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে সেরে উঠেছে তারাও প্লাজমা দান করে গেছে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে। এখান থেকে প্লাজমা সরবরাহ করা হয়েছে দেশের সাধারণ জনগণের মাঝেও। এখন পর্যন্ত পুলিশ হাসপাতাল থেকেই বেশি রোগী সুস্থ হয়েছে।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, মানুষের সেবা করতে গিয়ে একের পর এক নজির স্থাপিত হচ্ছে। করোনা সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) শহর জীবাণুমুক্ত রাখাসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়। প্রতিটি এলাকায় দরিদ্র মানুষের মধ্যে সুরক্ষাসামগ্রী ও খাবার বিতরণ করছে ডিএমপি। বর্তমান লকডাউনে ৫০টি থানা এলাকায় প্রতিদিন পাঁচ হাজার হতদরিদ্রকে খাবার দিচ্ছে তারা।

প্রায় তিন হাজার র‌্যাব সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়। এর পরও পুলিশের এলিট ফোর্সটি করোনা মোকাবেলার পাশাপাশি মানবিক সহায়তার কাজ করছে। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মইন বলেন, ‘মোবাইল কোর্ট পরিচালনার পাশাপাশি আমরা প্রতিদিনই সুরক্ষাসামগ্রী ও খাবার বিতরণ করছি।’

বাংলাদেশ পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতিও (পুনাক) হতদরিদ্র মানুষের মাঝে ত্রাণ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। কক্সবাজারে করোনায় আক্রান্তদের জন্য বিনা মূল্যে অ্যাম্বুল্যান্স সেবা চালু করেছে পুলিশ। গত এপ্রিল মাস থেকে এই সেবা চলছে বলে জানান পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান। জয়পুরহাটের পুলিশ সুপার মাছুম আহাম্মদ ভূঞার উদ্যোগে গঠন করা হয়েছে অক্সিজেন ব্যাংক। আটটি অক্সিজেন নিয়ে জুন মাসে চালু করা এই ব্যাংক থেকে করোনা রোগীদের বিনা মূল্যে অক্সিজেন সিলিন্ডার দেওয়া হচ্ছে। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা ও থানায় পুলিশের পক্ষ থেকে এমন অনেক উদ্যোগের খবর শোনা যাচ্ছে।

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ ও পুলিশ সদর দপ্তরের ফেসবুক পেজে সহায়তা চেয়ে অনেকেই ত্রাণসহ আইনগত সেবা পাচ্ছে দ্রুত। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ ইউনিটের প্রধান, অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ বলেন, ‘হাজার হাজার মানুষ আমাদের কাছে ত্রাণের জন্য, অ্যাম্বুল্যান্সের জন্য—এমনকি ডাক্তারের জন্য কল করেছে। আমরা তাদের সবাইকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছি। ত্রাণের জন্য ৩৩৩ নম্বর সংযুক্ত করা হয়েছে। অনেক স্থানে পুলিশও খাবার নিয়ে গেছে। অসুস্থ ব্যক্তি বাসায়, কখনো রাস্তায় পড়ে ছিল; পুলিশের গাড়ি গিয়ে তাকে হাসপাতালে পৌঁছে দেয়। আমরা সরাসরি অ্যাম্বুল্যান্স মিলিয়ে দিই। ডাক্তার বা হাসপাতালের ব্যাপারে আমরা নম্বর সরবরাহ করি।’

গত বছরের ১৩ আগস্ট বরিশাল শহরে কলেজ রোডের লিচুশাহ সড়কের পাশে পড়ে ছিলেন এক বৃদ্ধ। ৯৯৯-এ কল পেয়ে কোতোয়ালি থানার পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। গত বছরের ১৮ আগস্ট ময়মনসিংহের পাটগুদাম বাসস্ট্যান্ড ব্রিজ মোড়ে অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলেন এক ব্যক্তি। কোতোয়ালি থানার পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়। গত বছর নারায়ণগঞ্জে করোনা ধরা পড়ায় মধ্যরাতে একজন রোগীকে বাড়ি থেকে বের করে দেন বাড়িওয়ালা। খবর পেয়ে গভীর রাতে সেখানে পুলিশ পৌঁছে এবং তাঁকে বাড়িতে তুলে দিয়ে আসে। সেই সঙ্গে বাড়িওয়ালাকে বোঝানোর চেষ্টা করে—এভাবে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে নয়, বরং স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। রাজধানীর বংশালে এক অন্তঃসত্ত্বা নারীকে নিজেদের গাড়িতে হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ। কলাবাগানে ভাড়া দিতে না পারায় অসহায় ভাড়াটিয়াকে বের করে দেওয়ার ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নেয় পুলিশ।

এই বিভাগের আরও খবর