img

ইংল্যান্ডের নরফোকের ফাকেনহাম নামক এক ছোট্ট শহরে ১১ জানুয়ারি ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন সাইমন ড্রিং। শৈশবকালে আওজ নদীতে উলঙ্গ অবস্থায় সাঁতার কাটার অভিযোগে তাকে বোর্ডিং স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এরপর তিনি কিংস্‌লিন টেকনিক্যাল কলেজে অধ্যয়ন করেন। ১৬ বৎসর বয়সে তিনি বাড়ি ছাড়েন। ১৯৬২ সালে বহিঃবিশ্ব ভ্রমণের অংশ হিসেবে ভারত ভ্রমণ করেন।

১৭ বছর বয়সে তিনি প্রথম চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯৬৩ সালে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ওয়ার্ল্ড সংবাদপত্রে 'প্রুফ রিডার' (সম্পাদনা সহকারী) হিসেবে কাজ করেন। তারপর ১৯৬৪ সালে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসের স্ট্রিংগার হিসেবে কাজ করেন লাওস থেকে।  একই বছর ভিয়েতনাম ভ্রমণ করেন। সেখানে তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের যুদ্ধবিষয়ক সংবাদ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। এর মাধ্যমেই তিনি রয়টার্সের সর্বকনিষ্ঠ বৈদেশিক সংবাদদাতা হিসেবে নিজেকে ইতিহাসের পর্দায় ঠাঁই করে নেন।

১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর পুরো দশক জুড়ে তিনি ডেইলি টেলিগ্রাফ সংবাদপত্র এবং বিবিসি টেলিভিশন নিউজের বৈদেশিক সংবাদদাতা হিসেবে সারা পৃথিবীতে কর্মরত ছিলেন। ঐ সময়ে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে প্রতিবেদন পাঠাতেন। ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ল্যাটিন আমেরিকা এবং ইউরোপের অস্থিতিশীল ঘটনাপ্রবাহ নিয়মিত তুলে ধরতেন সংবাদ মাধ্যমগুলোয়। পেশাগত জীবনে ২২টি যুদ্ধ ও অভ্যুত্থান কাভার করেছেন। 

বিবিসি টেলিভিশন ও রেডিও'র সংবাদ এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে কাজ করেছেন প্রায় ২০ বছর। এছাড়া চলচ্চিত্র, আন্তর্জাতিক ঘটনা এবং সঙ্গীত বিষয়ে তার রয়েছে ব্যাপক ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা। ইরানের শাহবিরোধী গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে প্রতিবেদন তৈরী করে সায়মন ড্রিং নন্দিত হয়েছিলেন এবং অর্জন করেছিলেন অনেক পুরস্কার।

সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি দু'বার আহতও হয়েছিলেন। প্রথমবার ভিয়েতনামে এবং দ্বিতীয়বার সাইপ্রাসে তুর্কিদের আগ্রাসনে। বিবিসি রেডিও এবং টেলিভিশনে কাজ করার পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে লিখেছেন তিনি।

ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের গণহত্যার ওপর প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদন তাকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি ও সুনাম এনে দেয়। সাইমন ড্রিং বাংলাদেশের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী প্রথম বিদেশি সাংবাদিক যিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরি করে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দেন পাকিস্তানি বাহিনীর লোমহর্ষক নির্যাতন ও গণহত্যার কথা।

সপ্তাহখানেকের জন্য ঢাকা এসে সাইমন ড্রিং ফিরে যাওয়ার কথা আর ভাবতেই পারলেন না। পাকিস্তানের রাজনীতি ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আন্দোলন–সংগ্রাম সম্পর্কে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা শুরু হলো। শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হলো। সখ্য গড়ে উঠল অনেকের সঙ্গে। সর্বশেষ রাজনৈতিক ঘটনাবলি নিয়ে তিনি নিয়মিত প্রতিবেদন পাঠাতে লাগলেন লন্ডনে।

২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরু করার আগেই ঢাকায় সে সময় অবস্থানরত সব বিদেশি সাংবাদিককে ওই হোটেলে অবরুদ্ধ করে ফেলে। সেনা কর্তৃপক্ষ তাঁদের বলে, শহরের পরিস্থিতি খুব খারাপ, নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁদের হোটেলের ভেতরেই অবস্থান করতে হবে। অবরুদ্ধ বিদেশি সাংবাদিকেরা সারা রাত গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান, কেউ কেউ জানালা দিয়ে দেখতে পান আগুন। পরদিন সকালেই তাঁদের বিমানবন্দরে নিয়ে তুলে দেওয়া হয় উড়োজাহাজে।

কিন্তু পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ সাইমন ড্রিংকে খুঁজে পায়নি। তিনি প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে হোটেলেই লুকিয়ে ছিলেন। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ উঠে গেলে হোটেলের কর্মচারীদের সহযোগিতায় ছোট্ট একটি মোটরভ্যানে করে ঘুরে ঘুরে দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা।

 ২৭ মার্চ তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করে ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রতিবেদন আকারে প্রেরণ করেন যা ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান ( শিরোনামে ৩০ মার্চ প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনমত সৃষ্টিতে তার এ প্রতিবেদনটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সাড়া জাগিয়েছিল। উক্ত প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে,

"আল্লাহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও সন্ত্রস্ত এক নগর। পাকিস্তানি সৈন্যদের ঠান্ডা মাথায় টানা ২৪ ঘণ্টা গোলাবর্ষণের পর এ নগরের...।”

১৯৭১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাকে জোরপূর্বক দেশ থেকে বের করে দিয়েছিল। ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে পুনরায় নভেম্বর, ১৯৭১ সালে কলকাতায় আসেন তিনি। সেখান থেকে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় খবরাখবর নিরপেক্ষভাবে ঐ দৈনিকে প্রেরণ করতেন। ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে বিজয়ের দিনে যৌথবাহিনীর সাথে তিনিও ঢাকায় এসেছিলেন।

তলপেটে সার্জারি চলাকালে গত শুক্রবার (১৬ জুলাই) লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেছেন তিনি। 

এই বিভাগের আরও খবর