img

গত ছয় বছরে দেশের ১৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে নষ্ট হয়েছে এক হাজার ১৬৮টি বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। একই সময়ে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে, কিন্তু মেরামতযোগ্য এমন যন্ত্রের সংখ্যা চার হাজার ৩৮৯টি। ‘বাংলাদেশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষা সুবিধাদি উন্নয়নকল্পে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ক্রয়’ শীর্ষক প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।

kalerkanthoপরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তব পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ চলতি বছরের জুনে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রকল্প মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের আওতায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বাস্তবায়ন করে। এই প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল ছিল ২০০৯ সালের জুন মাস থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পে মোট ব্যয় ছিল ২০ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।

গবেষক ও শিক্ষাবিদরা বলছেন, এসব প্রকল্পে যন্ত্রপাতি কেনাকাটা করা হয় অপরিকল্পিতভাবে, মূলত বৈদেশিক অর্থায়নে এসব প্রকল্পে গবেষকদের যা চাহিদা তা ক্রয় করা হয় না। ফলে দেখা যায়, বেশির ভাগ যন্ত্র অব্যবহৃত থেকে নষ্ট হয়, রাষ্ট্রের ক্ষতি হয় কোটি কোটি টাকা। 

এ বিষয়ে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গবেষণাকাজে আধুনিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির গুরুত্ব অনেক। বিশেষ করে সায়েন্সের ক্ষেত্রে এই অবদানকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ল্যাবরেটরির আধুনিক যন্ত্রপাতির যে দশা তার অন্যতম কারণ হচ্ছে অপরিকল্পিত ক্রয়। আমরা ফান্ড পাই আর ক্রয় করি, কিন্তু কী যন্ত্রপাতি লাগবে তা আমরা জানি না। আমাদের চাহিদাটা আসে ওপর থেকে, ভেতর থেকে নয়। এতে অর্থের অপচয় হয়, ব্যাহত হয় গবেষণা কার্যক্রম।’ তিনি গবেষকদের স্বার্থে গবেষণাকেন্দ্রিক যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং এর পাশাপাশি গবেষণার জন্য বরাদ্দ দেওয়ার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ওই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সাময়িক জ্ঞান অর্জন করা। এই প্রকল্পের আওতায় দেশের ১৮টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ৪৮ হাজার ৬০টি বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়। প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৮২.৩ শতাংশ অর্থাৎ প্রকল্প সমাপ্ত করতে ব্যয় হয়েছে মোট ১৭ হাজার কোটি টাকা এবং ভৌত অগ্রগতি ১০০ শতাংশ।

ওই ১৮ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় (কুষ্টিয়া), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (সিলেট), খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (গাজীপুর), হাজী মো. দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (দিনাজপুর), মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (টাঙ্গাইল), পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডি বিভাগের জুনে প্রকাশিত প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নষ্ট ও মেরামতযোগ্য গবেষণা যন্ত্রপাতি রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই প্রতিষ্ঠানে প্রকল্পের আওতায় মোট প্রাপ্ত যন্ত্রপাতির সংখ্যা আট হাজার ১২৭টি। এর মধ্যে সচল রয়েছে ছয় হাজার ৫৩৫টি যন্ত্র আর মেরামতযোগ্য ও নষ্ট হওয়া যন্ত্রের পরিমাণ এক হাজার ৫৯২টি। এর পরেই আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকল্পের আওতায় মোট প্রাপ্ত যন্ত্রপাতির পরিমাণ সাত হাজার ৫২৬টি; তার মধ্যে সচল রয়েছে ছয় হাজার ৫৭৮টি যন্ত্র আর মেরামতযোগ্য ও নষ্ট হওয়া যন্ত্রের পরিমাণ ৯৪৮টি। এর পরেই আছে কুষ্টিয়ার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়। এই প্রতিষ্ঠানে প্রকল্পের আওতায় মোট প্রাপ্ত যন্ত্রপাতির সংখ্যা সাত হাজার ৯৬৯। এর মধ্যে সচল আছে সাত হাজার ৩৩৮টি যন্ত্র এবং মেরামতযোগ্য ৪১৩টি ও নষ্ট ২১৮টি যন্ত্র। এই তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু প্রকল্পের আওতায় পাওয়া মোট যন্ত্রপাতির সংখ্যার ওপর প্রতিবেদন করা হয়েছে।

অন্যদিকে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকল্পের আওতায় প্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সংখ্যা মাত্র ৪৫৬টি। তার মধ্যে সচল রয়েছে ৪১৬টি যন্ত্র। যন্ত্রের দিক দিয়ে তার থেকে কিছুটা এগিয়ে আছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এই প্রতিষ্ঠানে প্রকল্পের আওতায় মোট প্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সংখ্যা ৫৫১, তার মধ্যে সচল আছে ৪৭৮টি। বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের দিক দিয়ে এই দুই প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে থাকলেও ঢাকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এই প্রতিষ্ঠানে যন্ত্রপাতি প্রকল্পের আওতায় মোট প্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সংখ্যা ৬১৮। তার মধ্যে সচল ৫৮০টি।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম যন্ত্রপাতি রয়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে, তবে তা নিয়ে সন্তুষ্ট এই প্রতিষ্ঠানের উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আসলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় খুবই ছোট একটি বিশ্ববিদ্যালয়। তবে আমরা সারা দেশের সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গবেষণার দিক দিয়ে এগিয়ে আছি।’ গবেষণা সংকট এবং বাজেটে বরাদ্দ আছে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, আমাদের কোনো সংকট নেই। সরকারকে ধন্যবাদ, আমাদের এত সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য।’

তবে ভিন্নমত পোষণ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গবেষক ডা. এ কে এম শাহনাওয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে যন্ত্রগুলো ক্রয় করে তার বেশির ভাগ অব্যবহৃত থেকে যায় আর দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকার কারণে এসব যন্ত্র নষ্ট হয়ে যায়, যা আইএমইডির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। খোঁজখবর নিলে দেখা যাবে, এসব যন্ত্রের কোনো কোনোটির প্যাকেটটিও এখনো খোলা হয়নি।’ গবেষণার অর্থায়নের অভাবের কথা উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের গবেষকদের নানামুখী সমস্যা রয়েছে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে অর্থায়ন না হওয়া। আমাদের বাজেটে এই খাতে খুব কম অর্থায়ন হয়।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি সচল রাখার অন্যতম উপায় নিয়মিত গবেষণা করা বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন তাঁদের দক্ষতা বেড়েছে

এই জরিপে এক হাজার ৩০০ শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়ে জানা গেছে, ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন যে ব্যাবহারিক ক্লাসের আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে তাঁদের দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সমীক্ষার ৩৮ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন যে তাঁদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এই প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। প্রকল্পের আওতায় ক্রয় করা যন্ত্রপাতিগুলো অধিক প্রয়োজনীয় বলে মন্তব্য করেন গবেষণায় অংশগ্রহণ করা ৭৫.৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে ৯২.৯ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন যে তাঁদের গবেষণার পথ প্রশস্ত হয়েছে। ৯৫.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন যে উচ্চশিক্ষায় প্রবেশাধিকার বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে এই প্রকল্প।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ক্রয় ও ব্যবহার প্রতিবেদন বিষয়ে জানতে চাইলে আইএমইডির সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আসলে আমরা আমাদের পর্যবেক্ষণে দেখেছি যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট এবং অনেকগুলো মেরামতযোগ্য। ঠিক কেন কী কারণে নষ্ট হলো, তা বলা কঠিন। তবে আমরা যেটা বলতে পারি সেটা হলো, যেহেতু প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদন থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি, সেহেতু আশা করি, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই প্রতিবেদন থেকে তাদের ভুল-ত্রুটিগুলো দূর করে সঠিক পদ্ধতিতে গবেষণাকাজ চালাবে এবং বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিগুলো রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে সচল রাখবে।’

এই বিভাগের আরও খবর