img

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অর্থ ও পরিকল্পনা উপকমিটির সহসম্পাদক রাজীব পারভেজ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পটুয়াখালী-১ আসন থেকে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। এলাকায় তাঁর পোস্টারও সাঁটানো হয় তখন। দল তাঁকে মনোনয়ন দেয়নি।

এরপর কেটে যায় এক বছরের বেশি সময়। গত ২২ মার্চ তাঁকে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। পরিচালক বানানোর সময় তাঁর পরিচয় দেওয়া হয় ‘গভর্ন্যান্স পলিসি এক্সপ্লোর সেন্টার’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক। তবে এই প্রতিষ্ঠানটির কোনো ওয়েবসাইট খুঁজে পাওয়া যায়নি। ২০১৭ সালের পর ফেসবুক পেজও হালনাগাদ হয়নি এর।

একইভাবে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির সহসম্পাদক কে এম এন মনজুরুল হক ওরফে লাবলু দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন গোপালগঞ্জ-১ আসন থেকে। এলাকাবাসীর নামে তিনিও প্রচারণা চালিয়ে মনোনয়ন লাভে ব্যর্থ হন। এরপর ২০১৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর নতুন করে অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতা। এর আগেও তিনি অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন।

এভাবে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে আবারও দলীয় কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়েছে। সাংসদ পদে নির্বাচনে মনোনয়ন না দিলেও ব্যাংকের পরিচালক পদ দিয়ে সন্তুষ্ট রাখা হচ্ছে। ২০০৯ সালেও একই পদ্ধতিতে পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। অথচ কাদের পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া যাবে, এ নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিজেরই একটি প্রজ্ঞাপন রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় নিজের প্রজ্ঞাপনই মানছে না।

অর্থমন্ত্রীর নির্দেশে ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার মূল কাজটি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০০৯ সালে অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর শুধুই দলীয় বিবেচনায় ব্যাংকগুলোতে পরিচালক নিয়োগের পর ব্যাংক খাতে যেসব কেলেঙ্কারির জন্ম হয়, ২০১৪ সালে আবার অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর সে পথে আর যাননি তিনি। এ দফায় তিনি নির্ভর করেন সাবেক আমলা ও ব্যাংকারদের প্রতি।

আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রী হওয়ার প্রথম বছর আগের ধারাবাহিকতায় চললেও সম্প্রতি সে জায়গা থেকে সরে এসে একটু একটু করে আবার দলীয় বিবেচনায় লোক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বিভাগটিতে বর্তমানে ৩০টির মতো দলীয় কর্মীর জন্মবৃত্তান্ত জমা রয়েছে বলে জানা গেছে। সূত্রগুলো জানায়, ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ বা ছাত্রলীগের কোনো না কোনো বর্তমান ও সাবেক নেতা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে ধরনা দিচ্ছেন। কেউ সরাসরি আসছেন, কেউ বা তদবির করছেন ফোনে।

অথচ পরিচালকদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। ঘুষ বা তদবির-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রমাণ পেলেও তাঁদের কোনো শাস্তির উদাহরণ নেই। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব থাকার সময় ইউনুসুর রহমান প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিলেও মো. আসাদুল ইসলাম সচিব হয়ে আসার পর তা থেমে গেছে।

রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে সরকার ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঢালাওভাবে দলীয় লোক নিয়োগ দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা শেখ আবদুল হাই বাচ্চু, মহিলা আওয়ামী লীগের নেতা জান্নাত আরা, আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা নাগিবুল ইসলাম, সাইমুম সরওয়ার কমল, মাহবুবুর রহমান ভুঁইয়া, যুবলীগের খোন্দকার জাহাঙ্গীর কবির, সাবেক ছাত্রলীগের বলরাম পোদ্দার, সুভাষ সিংহ রায়, শাহজাদা মহিউদ্দিন, জাকির আহমেদ, আবদুস সবুর প্রমুখ। এই সময়ে ব্যাংক খাতে হল-মার্ক, বেসিক ব্যাংক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট গ্রুপসহ বিভিন্ন কেলেঙ্কারির জন্ম হয়।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি একই বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ বি এম রুহুল আজাদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। রুহুল আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পর্ষদ ছোট আকারের হলেও এখন এগুলো ভালোই চলছে এবং দেখে-শুনেই পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। যে পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব, তাও নেওয়া হচ্ছে। কারও বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থাকলে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) জানাতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক।’

নিজের প্রজ্ঞাপনই মানছে না মন্ত্রণালয়

২০১৫ সালের পর থেকে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে সাবেক আমলাদের। সাবেক ব্যাংকাররাও আছেন পর্ষদগুলোতে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদগুলোকে অধিকতর কার্যকর, দক্ষ ও পেশাভিত্তিক করতে ২০০৯ সালের ১২ এপ্রিল একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ব্যাংকের পর্ষদগুলোতে অর্থনীতিবিদ; সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ (সিএ); আর্থিক বাজার, মুদ্রানীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি; সাবেক ব্যাংকার, আইনজ্ঞ, বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ও কমপক্ষে একজন নারী পেশাজীবী থাকবেন।

প্রায় এক যুগ হতে চললেও পর্ষদ সদস্য বা পরিচালক নিয়োগে ওই প্রজ্ঞাপনের কোনো প্রতিফলন বা বাস্তবায়ন নেই। শুরু থেকে এ প্রজ্ঞাপন লঙ্ঘন করে আসছে অর্থ মন্ত্রণালয় নিজেই। ২০১০ সালে নতুন করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে লঙ্ঘনের দায়ভার এ বিভাগেরই।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, পরিচালক নিয়োগের ফাইল অর্থমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হচ্ছে উপস্থাপনকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাবেক আমলাদের সম্পর্কের ভিত্তিতে। কোনো কোনো নাম আসে রাজনৈতিক বিবেচনায়। তবে প্রজ্ঞাপনের ধারেকাছেও যাচ্ছে না আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সোনালী, অগ্রণী ও বিডিবিএলে একজন করে নারী পরিচালক থাকলেও জনতা, রূপালী ও বেসিক ব্যাংকে নেই। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোতে আর্থিক বাজার, মুদ্রানীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, গবেষকও নেই। অগ্রণী ব্যাংকে অবশ্য গবেষক আছেন একজন।

ব্যবস্থা নিতে পারে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক

সরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকির মধ্যেও নেই তারা। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো পরিচালক আমানতকারীদের জন্য ক্ষতিকর ভূমিকা রাখলে বাংলাদেশ ব্যাংক তাঁকে অপসারণ করতে পারবে। তবে সরকার কর্তৃক মনোনীত বা নিযুক্ত পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে না। আইনে আরও বলা আছে, তাঁদের আচরণ সম্পর্কে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা পরে সরকার গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অর্ধযুগে বেসিক ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছুই করেনি। আবার পরিচালকদের নিয়ে মতামত দেওয়ার পরও ব্যবস্থা না নেওয়ার নজির আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, স্রেফ দলীয় ব্যক্তিদের পরিচালক বানিয়ে সরকার আবার ভুল পথে যাচ্ছে। আবার ব্যাংকগুলোকে রাজনীতিবিদদের হাতে তুলে দেওয়ার উদ্যোগের খেসারত পুরো ব্যাংক খাতকে বহন করতে হবে। ব্যাংক যেহেতু আর্থিক প্রতিষ্ঠান, তাই পেশাদার ব্যক্তিদের দিয়ে এর পরিচালনা হওয়া উচিত। শুধু আমলানির্ভর রাখলে বড় ধরনের অনিয়ম-জালিয়াতি চলতেই থাকবে।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ আরও বলেন, ভালো ও দক্ষ সাবেক ব্যাংকার, আইনজীবী, ভালো ব্যবসায়ী, হিসাববিদ ও নিরপেক্ষ গবেষকদের পরিচালক বানানো উচিত। পরিচালকদের দায়দায়িত্ব এবং জবাবদিহিও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যাতে শাস্তি দিতে পারে, তাদের সেই ক্ষমতা দেওয়া জরুরি। পাশাপাশি দরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের দক্ষ নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা।

জিরোআওয়ার২৪/এমএ

এই বিভাগের আরও খবর