img

সাততলা বস্তির মেহেরুন্নেসার পরনে ফিরোজা রঙের নতুন শাড়ি। কোমরে গোঁজা মুঠোফোন, পান–সুপারির থলেটা দেখিয়ে বললেন, বস্তিতে যখন আগুন লাগে, তখন পরনের কাপড় আর ওই থলে ছাড়া ঘর থেকে কিছু নিয়ে বেরোতে পারেননি। দুরবস্থা দেখে একজন শাড়িটা দিয়ে গেছেন। সেই শাড়ি গায়ে জড়িয়ে গেল তিন দিন মেহেরুন্নেসা খোলা আকাশের নিচে।

রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তিতে আগুন লাগে গত সোমবার রাত ১২টার দিকে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের হিসাবে ওটা ছিল ঢাকার বস্তিতে এ বছরের আগুনের ২৮তম ঘটনা। এরপর এ সপ্তাহেই ঘটেছে আরও দুটি। সব মিলিয়ে গতকাল পর্যন্ত বছরের প্রথম ১১ মাসে বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ৩০টি। অবশ্য সব ঘটনা যে ভয়াবহ ছিল তা–ও নয়, কোনো কোনোটিতে ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয়নি। তবে প্রশ্ন হলো, এক সপ্তাহের ব্যবধানে তিনটি বস্তিতে কী করে আগুন লাগল তা নিয়ে।

গত সোমবার রাতে সাততলা বস্তিতে আগুন লাগার ১৬ ঘণ্টার ব্যবধানে মঙ্গলবার বিকেলে আগুন লাগে মোহাম্মদপুরের জহুরি মহল্লায়। জহুরি মহল্লার আগুন নিভতে না নিভতেই ওই দিন রাত আড়াইটার দিকে আগুন লাগে মিরপুরের বাউনিয়াবাদ এলাকার বস্তিতে। পুড়ে যায় শতাধিক ঘরবাড়ি ও দোকানপাট।

বস্তিতে আগুনের সর্বশেষ এ দুর্ঘটনার কারণ এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) জিল্লুর রহমান বলেন, তাঁদের তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। তবে তাঁরা ধারণা করছেন, বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে আগুন লেগেছে।

বস্তিবাসীদের অনেকেই মনে করেন, বস্তিতে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানো হয়। মোহাম্মদপুরের জহুরি মহল্লার ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের জনা দশেকের সঙ্গে কথা হয় গতকাল দুপুরের দিকে। আবদুল খালেক নামের একজন বলেন, ১৯৯১ সালে সরকারি জমিতে এ বস্তি ওঠে। এর আগেও এ জায়গা দখলে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল সরকার। আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় নিতে পারেনি। বস্তির বাসিন্দাদের কারও কারও অভিযোগ স্থানীয় কাউন্সিলর সলিমুল্লাহর দিকে। তাঁরা বলছেন, প্রায়ই তিনি লোক মারফত বস্তি ছেড়ে লোকজনকে চলে যেতে বলেন। এর আগেও একবার বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। বস্তির জমি বেচাকেনার ঘটনাও ঘটেছে। গতকাল ঘটনাস্থলে দেখা গেছে আবাসন প্রতিষ্ঠানের বড় সাইনবোর্ড।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে ফোন করা হলে সলিমুল্লাহ বলেন, ‘আমি কেন আগুন লাগাতে ইন্ধন দেব? আগে আমার সম্পর্কে ভালো করে জানবেন। তারপর কথা বলবেন। আমি ফোনে কথা বলব না। সামনাসামনি আসেন।’

মিরপুরের বাউনিয়াবাদ এলাকার বাসিন্দারা অবশ্য মনে করছেন, তাঁদের ওখানে মশার কয়েল থেকে আগুন লাগতে পারে। তাতেই একচালা টিনের বাড়িগুলো গেছে। উচ্ছেদের জন্য পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানো হয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন না।

আর মহাখালীর সাততলা বস্তির লোকজনের ধারণা, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। জায়গাটির মালিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ২০১০ সাল থেকে এ জমিতে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় একটি কমপ্লেক্স করার চেষ্টা করলেও উচ্ছেদের চেষ্টা করেনি। গতকাল সেখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা হয়। মেহেরুন্নেসা বলেন, ‘না হইলেও ৪০ বছর আছি। ছেড়ি আইছিলাম, বুড়ি হইছি। কুনো দিন আগুন ধরে নাই।’

ফায়ার সার্ভিসের হিসাবে গত বছর সারা দেশে ২৪ হাজার ৭৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর প্রধান কারণ ছিল বৈদ্যুতিক গোলযোগ। কমপক্ষে ৮ হাজার ৬৪৪টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে এ থেকে। দ্বিতীয় শীর্ষ কারণ চুলার আগুন। গত বছর ৪ হাজার ৪২৮টি অগ্নিকাণ্ডের পেছনে দায়ী ছিল চুলার আগুন। সিগারেটের আগুন থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ১৫৩টি।

ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) ঢাকার উত্তরাংশ ও টঙ্গীতে বিদ্যুৎ বিতরণ করে। ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কাওসার আমীর আলী বলেন, ডেসকো বস্তিতে বিদ্যুৎ সরবরাহের সময় তারগুলো যথেষ্ট সুরক্ষিত করে দেয়। ওখানে যে সমস্যাটা দেখা যায়, সেটা হলো একটা ঘর থেকে অন্যান্য ঘরে বিদ্যুতের সংযোগ নেওয়া হয়। তখন তারগুলো যথেষ্ট সুরক্ষিত থাকে না। তবে তা থেকে যে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, তাতে বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটার কথা নয়। আর তা ছাড়া শীতকালে বিদ্যুতের ব্যবহার কমে যায়। ফলে এ সময়ে বস্তিগুলোয় শুধু বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে আগুন লাগার বিষয়টা বোধ হয় ঠিক নয়।

জিরোআওয়ার২৪/এমএ

এই বিভাগের আরও খবর