img

আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর। সন্ধ্যা আনুমানিক সাতটা। তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লাগল। তখন যথারীতি ফায়ার অ্যালার্ম বেজে উঠল। অন্য কর্মীদের সঙ্গে অপারেটর আলেয়া বেগমও সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকেন। তিনতলা পর্যন্ত নামার পর আগুনের কালো ধোঁয়ায় দম নিতে পারছিলেন না। পিছু হটেন। অন্ধকারের মধ্যে চারতলায় ছোটাছুটি করতে থাকেন। বের হওয়ার পথ খোঁজেন। তখন বৈদ্যুতিক বাল্ব একটার পর একটা ফুটছে। ভয়াবহ অবস্থা। একপর্যায়ে জানালা ভেঙে লাফ দেন আলেয়া।

কারখানার গা-ঘেঁষা বাড়ির টিনের চালায় গিয়ে পড়েন আলেয়া বেগম। মেরুদণ্ড ও ঘাড়ের হাড় ভেঙে যায়। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত পান। আড়াই লাখ টাকা অর্থসহায়তা পেয়েছেন। কিন্তু চিকিৎসা করাতে তাঁর খরচ হয়েছে ১০-১২ লাখ টাকা। তারপরও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। শারীরিক যন্ত্রণা নিয়েই তিনি রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের ফুটপাতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন।

আলেয়া একা নন, তাঁর সঙ্গে তাজরীনের আরও বেশ কয়েকজন আহত শ্রমিক আছেন। এক-দুই দিন নয়, টানা ৬৯ দিন ধরে চিকিৎসার ব্যয় ও পুনর্বাসনের দাবিতে আন্দোলন করছেন। এত দিন হলেও সরকার বা পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তরফ থেকে কোনো আশ্বাস মেলেনি।

এদিকে তাজরীনের অগ্নিকাণ্ডের আট বছর পর হঠাৎ আহত শ্রমিকদের এই কর্মসূচিকে অনেকেই বাঁকা চোখে দেখছেন। হাতে গোনা দু-একটি ছাড়া অন্য শ্রমিক সংগঠনগুলো তাঁদের সহায়তা করছে না। অনেকটা খেয়ে না খেয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া শ্রমিকেরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অসুস্থ শ্রমিকদের একজন শারমিন বেগম গতকাল মারা গেছেন।

আট বছর পর কেন তাজরীনের আহত শ্রমিকেরা আন্দোলনে, তা জানতে গত মঙ্গলবার প্রেসক্লাবে গিয়ে আহত শ্রমিক সুমী আক্তার, আকাশ মৃধা, আঞ্জু আরা, হোসনে আরা ও মায়া আক্তারের সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের বক্তব্য, তাজরীনের অগ্নিকাণ্ডের পর যে অর্থসহায়তা পেয়েছেন, তা চিকিৎসার পেছনেই খরচ হয়ে গেছে। তারপরও পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন। তিন বেলা খাওয়ার জোগানোই কঠিন। এর ওপর নিয়মিত ওষুধের খরচ তো আছেই। বাসাভাড়া দিতে পারছেন না। দোকানেও বাকি অনেক টাকা। তাই তাঁরা অনেকটা বাধ্য হয়েই রাস্তায় নেমেছেন।

তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১১১ জন পোশাকশ্রমিক পুড়ে মারা যান। শতাধিক শ্রমিক আহত হন। অনেকেই এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। সেই ঘটনায় মামলা হলেও কাউকে শাস্তির মুখোমুখি করা যায়নি। মূল আসামি তাজরীনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন জামিনে আছেন।

নিশ্চিন্তপুরে বসবাসরত তাজরীনের আহত ৪৫ জন শ্রমিক গত সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। তাঁদেরই একজন সুমী আক্তার। তাজরীনের কারখানার পাঁচতলায় অপারেটর পদে কাজ করতেন। বোন নাজনীন আক্তারও তাঁর সঙ্গে কাজ করতেন। দুজনই সেদিন গুরুতর আহত হন।

জীবন বাঁচাতে চারতলা থেকে লাফ দিয়েছিলেন সুমী। তাঁর বাঁ পা ও কোমরের হাড় ভেঙে যায়। চিকিৎসা নিলেও স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেন না। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-নামতে অন্যের সাহায্য লাগে। চিকিৎসাকালেই সুমীকে ছেড়ে চলে যান তাঁর স্বামী। নিশ্চিন্তপুরে মা-বাবার সঙ্গে থাকেন। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। বাবা সবজি বিক্রি করেন। তা দিয়েই কোনো রকমে সংসার চলে।

সুমী আক্তার বললেন, ‘চিকিৎসার অভাবে পা’টাই বাতিল হয়ে গেল। সেদিনের ঘটনা ভুলতে পারি না। রাতে ঘুম আসে না। ভয় লাগে।’ তাঁর দাবি, ঘটনার পর চিকিৎসার জন্য রংপুরে থাকার কারণে তিনি কোনো আর্থিক সহায়তা পাননি।

তাজরীনের আহত শ্রমিকদের দাবির বিষয়ে শ্রমিকনেতা বাবুল আক্তার বলেন, নিহত ও নিখোঁজদের তুলনায় আহত শ্রমিকেরা অর্থসহায়তা কম পেয়েছেন। তাঁদের অনেকে আবার কাজ পাননি। তাই আহত শ্রমিকদের দায়িত্ব সরকার ও মালিকপক্ষকে নিতে হবে। শ্রমিকদের আজীবনের ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা ভাতা দেওয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

জিরোআওয়ার২৪/এমএ

এই বিভাগের আরও খবর