img

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। গত শনিবার বিশ্বে এক দিনে চার লাখের বেশি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হন। ফলে এই অবস্থায় বিশ্ববাজারে আবারও হুমকিতে পড়েছে জ্বালানি তেলের চাহিদা। গত শুক্রবার সপ্তাহের শেষ দিন বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল (১৫৯ লিটার) জ্বালানি তেলের (ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট—ডব্লিউটিআই) দাম কমে ৪০ ডলারের নিচে নেমে হয়েছে ৩৯ দশমিক ৯৩ ডলার। এ ছাড়া ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম কমে হয়েছে ৪১ দশমিক ৮১ ডলার।

আসলে চলতি মাসের শুরু থেকেই করোনার সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ায় অস্থির হয়ে পড়েছে তেলের বাজার। এই অক্টোবরেই বিশ্বে তেলের বাজারের অবস্থা নিয়ে সৌদির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ফোনে আলাপও করেন। তেল উৎপাদনের শীর্ষে থাকা দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে একমত প্রকাশ করেছেন তাঁরা। তেল রপ্তানিকারী দেশগুলোর সংস্থা (ওপেক) এবং এর মিত্রদের নিয়ে গঠিত ওপেক প্লাসের চুক্তির প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন তাঁরা।

অন্যদিকে এ বছর টালমাটাল হলেও ওপেক মনে করে, আগামী বছর তেলের চাহিদা বাড়বে। প্রতিদিন ৬৫ লাখ ব্যারেল তেলের চাহিদা বাড়বে আগামী বছর থেকে। ৯ কোটি ৬৮ লাখ ব্যারেলের বেশি তেল উৎপাদিত হবে।

স্ট্যাটিসটার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক চাহিদা ছিল প্রতিদিন ১০ কোটি ব্যারেলের বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২০ সালে এই চাহিদা কমে হবে ৯ কোটি ১৭ লাখ ব্যারেল। চাহিদা কমার মূল কারণ বিশ্বজুড়ে লকডাউন ও কোভিড-১৯–এর অর্থনৈতিক নেতিবাচক প্রভাব। তবে প্রাক্কলন হচ্ছে, আগামী বছর চাহিদা বাড়লেও তেলের দাম খুব বেশি বাড়ছে না।

গত আট মাসে যে অবস্থায় ছিল তেলের বাজার

অপরিশোধিত তেলের দাম ৫০ ডলারের নিচে নেমে আসে, যা ছিল এক বছরের বেশি সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন দাম। পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও করণীয় নির্ধারণে গত ৫ মার্চ থেকে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় বৈঠকে বসে ওপেক এবং ওপেকের বাইরের দেশগুলো। এতে সিদ্ধান্ত হয়, তেলের দাম বাড়াতে অপরিশোধিত তেলের উৎপাদন দিনে ১৫ লাখ ব্যারেল কমাবে তারা, যা বিশ্বের মোট সরবরাহের প্রায় ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। ওপেক আশা করছিল, রাশিয়া প্রতিদিন ৫ লাখ ব্যারেল উৎপাদন কমাতে সম্মত হবে। তবে এতে সম্মতি জানায়নি রাশিয়া। বিষয়টি ভেস্তে যায়। এর প্রভাবে ব্যাপক দরপতন হয় তেলের দামের।

বিশ্বের ইতিহাসে এমনটা আর আগে হয়নি। পরে অনেক আলোচনা–পর্যালোচনা শেষে দাম বাড়াতে ওপেক প্লাস ও অন্য তেল উৎপাদক মিত্রদেশগুলো উৎপাদন কমানোর এক ঐতিহাসিক সমঝোতায় পৌঁছায়। দৈনিক ৯৭ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন কমানোর ব্যাপারে একমত হয় তারা, যা বিশ্বের মোট উৎপাদনের ১০ শতাংশ। এভাবে দামের ওঠানামা চলছে আট মাস ধরেই। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। গত বৃহস্পতিবার এক দিনেই ৭০ হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হন। শুক্রবার আরও বেশি। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রে তেলের চাহিদা কমেছে, যার কিছুটা প্রভাব ইউরোপেও দেখা যাচ্ছে। অপরিশোধিত তেলের দাম ৪০ ডলারের সামনে পেছনে আটকে রয়েছে।

এশিয়ায় ভিন্ন পরিস্থিতি

বিশ্বের পশ্চিম ও পূর্বের মধ্যে জ্বালানি তেলের চাহিদা বেশ ফারাক দেখা যাচ্ছে এখন। করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়ায় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকায় তেলের চাহিদা ব্যাপক কমেছে। অন্যদিকে এশিয়াতে জেট ফুয়েলের চাহিদা বেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, বর্তমানে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে তেলের চাহিদার ব্যাপক ফারাক লক্ষ করা যাচ্ছে। এশিয়া ইতিমধ্যে পূর্ব-মহামারি চাহিদা স্তরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে জোগানের দিক দিয়ে দেখলে দেখা যায়, লিবিয়ার তেলের উৎপাদন এ মাসের শেষের দিকে আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে, যা অপরিশোধিত তেলের ওপর আরও চাপ ফেলবে।

এদিকে মার্কিন নির্বাচনও প্রভাব ফেলবে তেলের দামে। আগামী ৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী লড়াই। এ লড়াইয়ে একদিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প, অন্যদিকে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন। নির্বাচনের এই লড়াইয়ের মধ্যেই শুরু হয়েছে নানা হিসাব-নিকাশ। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে পদক্ষেপ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কী বিশ্বাস করেন, তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে।

মার্কেট ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রাম্প মূলত জলবায়ুবিজ্ঞানকে উপেক্ষা করেছেন এবং তেল ও গ্যাসের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ট্রাম্পের রিপাবলিকান প্রশাসন শিল্পের জন্য নিয়মাবলি শিথিল করাসহ নতুন অবকাঠামো অনুমোদনের প্রক্রিয়া দ্রুত করার বিষয়ে জোর দেবে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ট্রাম্পের বিজয়ের অর্থ হবে তেলের বাজারের জন্য যথারীতি ব্যবসা। অন্যদিকে বাইডেন জানান, নির্বাচিত হলে তাঁর প্রশাসন জীবাশ্মভিত্তিক তেল ও গ্যাসের বদলে পুরোপুরি নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের ওপর জোর দেবে। ট্রাম্প মনে করেন, এতে আমেরিকার তেল ও গ্যাসশিল্প ধ্বংস হবে। তাই বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন জয়ী কে হবেন, তার ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে দেশটির তেল-গ্যাস ব্যবস্থাপনা।

গণমাধ্যম সিএনবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন ব্যাংক ও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকস বলছে, বাইডেন প্রশাসন এলে উৎপাদন আরও ব্যয়বহুল ও নিয়ন্ত্রিত করে তেলের দাম বাড়াতে পারে। বাইডেন ২০৩৫ সালের মধ্যে একটি কার্বন দূষণমুক্ত জ্বালানি খাত অর্জনের ওপর জোর দিয়েছেন।

জিরোআওয়ার২৪/এমএ

এই বিভাগের আরও খবর