img

পার্বত্য চট্টগ্রামের চতুর্থ বৃহত্তম জাতিসত্তা ম্রোদের নিয়ে নৃবিজ্ঞানের এক বিখ্যাত বই আছে। এর নাম ম্রু। লেখক এল জি লফলার ও সি ডি ব্রাউন্স। দুজন সেই পঞ্চাশের দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ম্রো-অধ্যুষিত গ্রামে কাটান বছরখানেক। সেই বইয়ে খুঁজে পাওয়া যায় অধুনা বহুল প্রচলিত ‘লকডাউনের’ কথা।

মে থেকে জুলাই মাসে গ্রামগুলোতে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এ সময় হয় গ্রাম বাইরের মানুষের জন্য বন্ধ করে দেওয়া, নয়তো লোকজন গ্রাম ছেড়ে চলে যায়।

এই করোনাকালে ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে ব্যাপকভাবে। বলা হচ্ছে ভিড় এড়িয়ে চলতে। প্রায় কৃষিভিত্তিক জনগোষ্ঠী ম্রোরা মহামারির কালে ভিড় এড়িয়ে চলতেন। লফলার ও ব্রাউন্সের লেখায় পাই, সে সময় সামাজিক অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ জারি ছিল।

এমনিতেই বছরের এ সময় রোগশোক বেশি হলেই এমন করা হয়। এ সময়টায় নানা রকম বিধিনিষেধ মানতে হয় ম্রোদের। যেমন গ্রামের কোনো ঘরে মাংস রাখা যায় না, খেতে তো পারবেই না। প্রাণী হত্যা বন্ধ থাকে। গ্রামে হইহল্লাও নিষেধ।

ইয়াংগন ম্রো বলেন, এবার করোনাকালে গ্রামটি সাতটি সুতা দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। গ্রামের ফটক নতুন করে তৈরি হয়। রাত আটটার পর গ্রামবাসীকে আর গ্রামে ঢুকতে দেওয়া হয় না। বাইত্তাপাড়ায় এ ব্যবস্থা কঠোরভাবেই পালন করা হয়েছে। এর ফলও পাওয়া গেছে। পুরো গ্রামে কোনো সংক্রমণ হয়নি।

শুধু ম্রোদের নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি পাহাড়ি জাতিসত্তার সবারই এ ধরনের লকডাউনের প্রথা রয়েছে। মহামারির সময়ে বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষ তা মেনেও নিয়েছে। ১১টি জাতিসত্তার মানুষ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসব তথ্য সংগ্রহ করেছে। করোনা মহামারির সময়ে এমন নানা উপায় অবলম্বন করেছেন রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেকের শিয়ালদাই পাড়ার মানুষ।

অধুনা পর্যটনের এক জনপ্রিয় স্থান পাহাড় আর বনঘেরা সাজেক। এখানকার রুইলুই এলাকাতেই গড়ে উঠেছে পর্যটনের নানা স্থাপনা। এ জায়গা থেকে হেঁটে শিয়ালদাই লুই মৌজার শিয়ালদাই পাড়া গ্রামে যেতে আড়াই ঘণ্টা লাগে। গ্রামের ৬৫ পরিবারের সবাই ত্রিপুরা। গ্রামের বাসিন্দা ও মৌজার হেডম্যান (মৌজাপ্রধান) জোই পুই তাং ত্রিপুরা বলছিলেন, ‘করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর থেকেই আমরা গ্রাম বন্ধ করে দিই। ত্রিপুরা ভাষায় একে বলে “পুষ্কারা খেলাইমানি”। আমরা গ্রামের প্রবেশ-বাহিরের সব রাস্তা বাঁশ দিয়ে ঘিরে দিয়ে একটি পথ রেখেছি। এ পথেই গ্রামের মানুষের আসা-যাওয়া। গ্রামে বাইরের লোকের প্রবেশ বন্ধ।’

রাঙামাটি জেলার সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, দেশে করোনা সংক্রমণের ৫৮তম দিনে ৬ মে রাঙামাটিতে করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। করোনা সংক্রমণের ক্ষেত্রে দেশের সর্বশেষ জেলা ছিল রাঙামাটি।

জনসংখ্যার ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহৎ জনগোষ্ঠী মারমা। তাদের ভাষায় পাড়া বন্ধ করে দেওয়াটা হলো ‘রোয়া খাং’। করোনা সংক্রমণ শুরুর পর পার্বত্য চট্টগ্রামের যেসব মারমা-অধ্যুষিত গ্রামে লকডাউন করা হয়েছে, এর মধ্যে আছে হাংসামা। বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলার এ গ্রামে ৪৮ পরিবারের বাস। সবাই মারমা আর প্রায় সবাই জুমিয়া।

একটি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী মং মং সিং বলেন, পাড়া বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়টি মারমারা প্রতিবছর একবার করেন। বছরের কোনো শনি বা মঙ্গলবার এটি করা হয় মূলত পাড়ার মানুষের মঙ্গলের জন্য। কেউ গ্রাম থেকে বের হতে এবং ঢুকতেও পারে না।

হাংসামা গ্রামে গত এপ্রিল থেকে শুরু হয় লকডাউন। এ গ্রামে কোনো সংক্রমণ হয়নি। এখানে কারও উপসর্গ ছিল না বলে কেউ পরীক্ষা করাতেও যাননি।

বান্দরবানের ডলুপাড়া গ্রামে প্রায় ১০ বছর আগে ডায়রিয়ায় পাঁচজনের মৃত্যু হয়। তখন গ্রামটি লকডাউন করে দেয় গ্রামবাসী। বর্তমান সিভিল সার্জন অং সুই প্রু তখন একটি উপজেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি নিজে একটি মাইক্রোবাসে করে সেখানে গেলে গ্রামবাসী তাঁকে ঢুকতে দিতে সম্মত হন। তাঁর মতে, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে লকডাউনের যে প্রথা আছে, এর সঙ্গে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার মেলবন্ধন ঘটাতে হবে। দুয়ের মিল হলে ফল পাওয়া যায় খুবই চমৎকার। এবার করোনায় এমনটি হয়েছে।

লকডাউনের সময় খাদ্য একটা বড় সমস্যা। কিন্তু এবার করোনাকালে বান্দরবানের রোয়াংছড়ির খুমি গ্রামমংইউ পাড়ায় এ নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। গ্রামের কারবারি নংরিং খুমি বলেন, ‘আমরা এক মাসের খাবার মজুত করে রেখেছিলাম। খুব প্রয়োজন না হলে বাজারে কেউ যেত না। আর আজ পর্যন্ত কেউ সংক্রমিত হয়নি।’

২৫ পরিবার আছে এই খুমি গ্রামে। প্রায় সবাই জুমিয়া। ‘আওয়াং ইয়া’ খুমি ভাষায় লকডাউন। এভাবে খাবারের সরবরাহ নিশ্চিত করা আধুনিক লকডাউনের অন্যতম শর্ত বলে জানান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু জামিল ফয়সাল।

জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘এসব প্রথা ও প্রাচীন জ্ঞান মোটেও ফেলনা নয়। এর চর্চা দরকার সরকারিভাবে। এটি আমাদের সার্বিক শিক্ষার জগতে নতুন সংযোজন ঘটাতে পারে।’

জিরোআওয়ার২৪/এমএ

এই বিভাগের আরও খবর