img

বাংলাদেশ ও ভারতের প্রবৃদ্ধির তুলনামূলক হিসাব উভয় দেশেই ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আইএমএফ হিসাব করে বলেছে যে ২০২০ সালে চলতি মূল্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৮৭ দশমিক ৯৭ মার্কিন ডলার। আর ২০২০ সালে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৭৭ মার্কিন ডলার। এর পাশাপাশি ২০২০ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ৩ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে এবং ভারতের জিডিপি ১০ দশমিক ৩ শতাংশ কমবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২০ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত তার ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’ নামক প্রতিবেদনটিতে সারা বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে যে পূর্বাভাস দিয়েছে, এই নিরূপণ তার অংশ।

তবে সামনের বছরগুলোয় দুই দেশের অর্থনীতির পরিবর্তন একই তালে চলবে না। আইএমএফের আউটলুক থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি বৃদ্ধি পাবে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। আর বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি বৃদ্ধি পাবে ৮ শতাংশ। ফলে, ২০২১ সালে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ৩০ মার্কিন ডলার এবং বাংলাদেশের হবে ১ হাজার ৯৯০ মার্কিন ডলার। ২০২৫ সাল পর্যন্ত আইএমএফের প্রক্ষেপণ বলছে, মাথাপিছু জিডিপিতে ২০২৪ সালে ভারত বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যাবে এবং ২০২৫ সালে আবার মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে থাকবে।

ভারতের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম বাংলাদেশের অর্জনের প্রশংসা করেছে। তারা ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরা কী ভুল করেছেন আর বাংলাদেশ কীভাবে ভালো করেছে, সেগুলো তুলে ধরেছে। ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দল এটিকে বর্তমান মোদি সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে দেখেছে। অনেকে বলছেন, কোভিড-১৯ অতিমারি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাই ভারতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যমের আরেকটি অংশ বাংলাদেশের অর্জনকে খুব একটা ভালোভাবে দেখেনি; বরং তারা এটিকে খাটো করে বেশ কিছু নেতিবাচক বিষয় তুলে ধরেছে। এর মধ্যে তৈরি পোশাকশিল্পে কমপ্লায়েন্সের অভাব, চরম রাজনৈতিক সহিংসতা, দুর্নীতি এবং ইসলামি উগ্রবাদকে বাংলাদেশের সমস্যা বলে উল্লেখ করেছে।

পৃথিবীতে বহু দেশ রয়েছে, যেগুলোর আয় বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে তারাও নানা ধরনের সীমাবদ্ধতার মধ্যে রয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতা এবং দুর্নীতি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোসহ সব স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে অতি পরিচিত সমস্যা।

মাথাপিছু জিডিপির হিসাব নিয়ে দুই দেশের কারওরই অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া জানানোর কোনো প্রয়োজন নেই। এর পেছনে যে কারণগুলো রয়েছে, তার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।

প্রথমত, জিডিপি যেভাবে হিসাব করা হয়, সেটি একটি ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতি। জিডিপি শুধু যেসব পণ্য ও সেবা বাজারে অর্থের বিনিময়ে কেনাবেচা করা যায়, সেগুলোকেই হিসাবের মধ্যে নেয়। বেতনবিহীন ঘরের কাজ, পারিবারিক সেবা, সমাজসেবা ইত্যাদি, অর্থাৎ যেগুলোর জন্য কোনো আর্থিক মূল্য পাওয়া যায় না, সেগুলোকে গণনার মধ্যে নেয় না। আবার অনেক ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড করলেও জিডিপি বাড়ে। যেমন গাছ কেটে বাজারে বিক্রি করলে সেই অর্থও জিডিপিতে যোগ হয়। অথচ গাছ কাটলে পরিবেশ বিনষ্ট হয়। মানুষের স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হয়। এ রকম অসংগতিমূলক অনেক কারণে জিডিপি একটি সংকীর্ণ সংখ্যা।

দ্বিতীয়ত, চলতি বাজারমূল্যে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের জিডিপির তুলনা করা সঠিক নয়। ডলারের মূল্য সব দেশে সমান হয় না। বাংলাদেশে এক ডলার দিয়ে যে পরিমাণ পণ্য এবং সেবা কেনা যাবে, অন্য দেশে সমপরিমাণ কেনা যাবে না। জীবনযাত্রার ব্যয় একেক দেশে একেক রকম। এ কারণেই চলতি মূল্যভিত্তিক জিডিপির পরিবর্তে ক্রয়ক্ষমতার সমতা বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটির (পিপিপি) ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশের জিডিপি তুলনা করা হয়।

তৃতীয়ত, আইএমএফের জিডিপির এই হিসাব অনেক অনুমাননির্ভর এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও পরিস্থিতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ সংখ্যাও পরিবর্তিত হতে থাকে। কখনো কখনো পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হতে থাকে এবং তা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে। কিন্তু তা জিডিপির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। জিডিপির হিসাব ওলট–পালট করে দেয়। তার প্রমাণ চলমান কোভিড-১৯ অতিমারি।

চতুর্থত, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব রাজনৈতিকভাবে কাম্য নয়। ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। এর অর্থনীতির আকার বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বড়। তবু অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী প্রতিবেশী পেলে ভারতের জন্য তা হবে মঙ্গলজনক। বাংলাদেশি নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে তাদের কাছে ভারতীয় পণ্য ও সেবার চাহিদা বাড়বে। ভারতে চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশি রোগীদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।

বাংলাদেশের জন্য ভারতের চেয়ে উচ্চতর মাথাপিছু জিডিপি একটি উল্লেখ্যযোগ্য অর্জন বটে। এখন এই অতিমারির সময়েও বাংলাদেশ ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। কৃষির উচ্চ ফলন, ভালো রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স বাড়ার কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। সামাজিক সূচকেও বাংলাদেশের অর্জন সবার জানা। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) বেশ কয়েকটি সূচকে বাংলাদেশ সাফল্য দেখিয়েছে। এমডিজির সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো (এসডিজি) বাস্তবায়নেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

তবে মাথাপিছু জিডিপির প্রক্ষেপণ নিয়ে বাংলাদেশের আত্মতুষ্টিতে ভোগা ঠিক হবে না। কেননা, উচ্চ প্রবৃদ্ধি থাকা সত্ত্বেও অর্থনীতিতে বিভিন্ন ধরনের দুর্বলতা সুস্পষ্ট। স্বল্প রাজস্ব আয় এবং বিনিয়োগ এখন বড় চ্যালেঞ্জ। আইএমএফের প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত হবে মাত্র ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় সরকারের ব্যয়ক্ষমতা সীমিত। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সরকারি ব্যয় বাংলাদেশ সবচেয়ে কম। এটি জিডিপির মাত্র ১৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ। বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত ২৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ, যা নেপাল ও ভুটানের তুলনায় অনেক কম এবং ভারতের কাছাকাছি (২৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ)। এর ফলে অর্থনীতি পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারছে না। তা ছাড়া উচ্চ প্রবৃদ্ধি–বৈষম্য দেশের ভেতরে হ্রাস করতে পারেনি। এর জন্য প্রয়োজন সুশাসন এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, যাতে সবাই প্রবৃদ্ধির সুফল পেতে পারে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং কর্মদক্ষতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার অত্যাবশ্যক। এটি এখনো একটি অসম্পূর্ণ কাজ।

সুতরাং, বাংলাদেশের জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ হলো একদিকে প্রবৃদ্ধির গতি বজায় রাখতে দুর্বল জায়গাগুলোকে শক্তিশালী করা, আর অন্যদিকে প্রবৃদ্ধিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই করার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ নেওয়া।

জিরোআওয়ার২৪/এমএ

এই বিভাগের আরও খবর