img

কোভিড-১৯ বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক মন্দার সৃষ্টি করেছে, তা থেকে হয়তো ২০২২ সালের আগে রেহাই পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। যদিও বিশ্বে যেসব মন্দার ইতিহাস রয়েছে তার একেকটা একেক কারণে হয়েছে। তাই বলা যায়, আগের মন্দাগুলোর মতো এটিও সংকটের দিকে যাচ্ছে।

মাস আটেক আগেও পৃথিবীর চিত্রটা এমন ছিল না। করোনা যেন সব অঙ্ক পাল্টে দিয়েছে। করোনা যে এত গভীর এক মন্দার দিকে টেনে নিয়ে যাবে বিশ্ব অর্থনীতিকে, তা যেন ধারণারও বাইরে ছিল। সব ধরনের সরকারি ও বেসরকারি হিসাব এ বছরের জন্য আশার কিছু শোনাচ্ছে না। এমনকি পরের বছরের জন্যও না। ২০২২ সাল পর্যন্ত লেগে যাবে বিশ্বকে করোনা-পূর্ববর্তী অবস্থায় আসতে। তাও আবার নির্ভর করছে কতটা সফলতা আসে করোনার টিকা নিয়ে। সেই সঙ্গে আর্থিক ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রক নীতিগুলোর সফলতার ওপরও। নীতিনির্ধারকেরা তাই পরিত্রাণের জন্য আগের মন্দাগুলোর সঙ্গে নতুন মন্দার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করছেন।

প্রথমেই বলছিলাম, এই বিশ্ব যে কটি মন্দা দেখেছে তার একটি অন্যটি থেকে আলাদা। একেকটি মন্দা একেকভাবে সামাল দিয়েছে সরকারগুলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বেশ কয়েকটি মন্দায় ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ আর্থিক নীতি কঠোর করে।

১৯৭৩-৭৫ ও ১৯৮১-৮২ এর গভীর মন্দা হয়েছে তেলের দামের ধাক্কায়। তখনকার অর্থনীতি বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি আমদানির ওপর নির্ভরশীল ছিল। ২০০৮ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রধান কারণ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের গৃহায়ণ খাতের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। দেশটির বন্ধকি বাজারের ঝুঁকিপূর্ণ ঋণব্যবস্থা ও আর্থিক খাতের শিথিলতা নিয়ন্ত্রণই মন্দার শুরুটা করেছিল। যাকে-তাকে ঋণ দেওয়া হচ্ছিল, যা বহন করার ক্ষমতা তাদের ছিল না এবং যা কাটিয়ে উঠতে প্রায় চার বছর লেগেছিল বিশ্বের। এরপর কটা বছর বেশ সাদামাটা কেটেছিল বিশ্বের।

অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, গভীর মন্দা সাধারণত দ্রুত পুনরুদ্ধার হয়, যেমন ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের ওপরে ছিল।

অন্যদিকে ১৯৯০-৯১ এর হালকা মন্দার পুনরুদ্ধার অপেক্ষাকৃত ধীরে হয়। নোবেলজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান বিষয়টিকে ‘প্লাকিং বা অবচয়’ প্রভাব হিসেবে অভিহিত করেন। এই তত্ত্বের সার কথা হলো, অর্থনীতির একটি বাদ্যযন্ত্রের তারের মতো —মন্দা ঋণাত্মক ঘটনা, যা তারটিকে নিচে টেনে নেয় এবং তারপর আবার তাকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে নেয়। আপনি যদি তারকে শক্তভাবে টানেন, তবে তা আরও দ্রুত আগের অবস্থায় যায়। এই তত্ত্বের সারমর্ম হলো, মন্দাটি যত গভীরতর হবে, তত দ্রুত পুনরুদ্ধার পাবে।

যেমন ২০০৮-এর মন্দাবস্থার পর ৮ বছর যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশের ঘরে ছিল। অর্থাৎ অন্য যেকোনো মন্দার চেয়ে পুনরুদ্ধারে বেশি সময় নিয়েছে। এর কয়েকটা ব্যাখ্যা রয়েছে। এক হলো—এই সময়টা ওবামাকেয়ারের মাধ্যমে অর্থনীতির বিস্তৃত অংশ যুক্ত করা হয়; ব্যাংকিং ও জ্বালানি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিশ্চয়তা তৈরি করে এবং আরেকটি হলো নানা ধরনের নীতিগত প্রতিক্রিয়া, যা কাজের উৎসাহ কমিয়ে দেয়।

অন্যদিকে ২০০৮-এর মন্দার আগে যুক্তরাষ্ট্রের সার্বভৌম ঋণ দেশটির জিডিপির ৩৫ শতাংশ ছিল। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে নানা ধরনের সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। এর ফলস্বরূপ ২০১৩ সাল নাগাদ দেশটির ঋণ জিডিপির ৭২ শতাংশে গিয়ে পৌঁছায়। ব্যবসা চক্রের সামঞ্জস্য রাখতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেকোনো প্রশাসনের চেয়ে সবচেয়ে বড় বাজেট ঘাটতি ছিল ওবামা প্রশাসনের। অবশ্য ট্রাম্পের ঘাটতি এখন তার চেয়েও অনেক বেশি। অর্থনীতিবিদেরা ২০০৮ সালের মন্দা যত দ্রুত কাটবে বলে ধারণা করছিলেন, ততটা দ্রুত কাটেনি। তবে এটাও সত্যি, ওই মন্দায় অনিশ্চয়তাও ছিল অনেক। ওই সময়ে নেওয়ার কথা ছিল, এমন অনেক কাজ এখনো

তবে এর আগে বৈশ্বিক মহামারির কারণে যে মন্দা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হলো ২০২০-এর এই মহামন্দা। যেমন ১৮৭০ সালে কলেরা মহামারির কারণে মাথাপিছু উৎপাদনে ধস নামে। তবে এবার উৎপাদনের সঙ্গে চাহিদার ঘাটতিও ব্যাপক। এ কারণে এই মন্দার গতি ও গভীরতা এমন প্রবল হয়েছে যে বিশ্ব অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের গতি হবে অনেক ধীর। যদিও মিল্টন ফ্রিডম্যানের তত্ত্ব অনুযায়ী মন্দার পরপর উৎপাদনে উল্লম্ফন ঘটে।। তবে এবার দেখা যাচ্ছে উদীয়মান বাজার এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে অন্তত ৬০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় সংকোচন হচ্ছে। মহামারির প্রতিকার এখনো মেলেনি। এক জায়গা থেকে প্রকোপ কমে গেলেও আবার তা ফিরে আসার সম্ভাবনা অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা জাগ্রত রাখছে।

বিষয়গুলো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি দিয়ে বুঝিয়ে বলা যায়। কোভিডের আগে যুক্তরাষ্ট্রের বেকারত্বের হার ছিল ঐতিহাসিক কম। মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯৩০ সালের মহামন্দার আগের অবস্থানের চেয়ে ভালো অবস্থায় ছিল ঋণ-জিডিপির অনুপাত। করপোরেট ঋণ একটু বেশি থাকলেও সেবার ব্যয় বেশ ভালো অবস্থানে ছিল। তবে সুদের হার কমানোর জায়গাটা বেশি ছিল না। সে অবস্থায় করোনা মহামারির প্রতিক্রিয়ায় ফেডকে দ্রুত শূন্য সুদের হার নীতি নিতে হলো। নীতিনির্ধারক এবং অর্থনীতিবিদেরা সতর্ক করলেন, এই মন্দা অন্য কোনো মন্দার মতো নয়।

আমেরিকানদের জন্য ২ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অভূতপূর্ব উদ্ধার প্যাকেজ ঘোষণা করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। উদ্ধার প্যাকেজের মধ্য অন্যতম ছিল মার্কিন জনগণকে সহায়তা করা, অর্থাৎ মার্কিন পরিবারগুলো সরাসরি নগদ অর্থ পাবে। পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পরিবারগুলোকে অতিরিক্ত অর্থ প্রদানের লক্ষ্যে পে-রোল ট্যাক্স স্থগিত করার নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন। ট্রাম্পের নতুন নির্বাহী আদেশের ফলে এখন থেকে দেশটির বেকার ভাতা সপ্তাহে ৬০০ ডলারের পরিবর্তে ৪০০ ডলার করে দেওয়া হবে। জুলাই মাসে এই ভাতা প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। তবে নতুন করে ভাতার পরিমাণ কমিয়ে মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। কত দিন পর্যন্ত এটি চলমান থাকবে, সে বিষয়ে পরিষ্কার কিছু জানায়নি হোয়াইট হাউস। এই অবস্থা কত দিন চলবে, তা এখনো বলা যাচ্ছে না। এই অনিশ্চয়তা বড় সমস্যা।

গুরুত্বপূর্ণ হলো, গত তিন দশকের অর্থনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল মূলত মুদ্রানীতিকে ঘিরে। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হওয়া সংকট বিভিন্ন দেশের আর্থিক খাতে প্রভাব ফেলেছিল। অন্যদিকে কোভিড থেকে সৃষ্টি হওয়া সংকট সারা বিশ্বে জীবন-জীবিকাসহ পর্যটন, এয়ারলাইনস, খুচরা ব্যবসা, গাড়িশিল্পকে মারাত্মক ক্ষতিতে ফেলেছে। এই মহামারি ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের তুলনায় অনেক বেশি শিল্পকে আরও কঠোরভাবে আঘাত করছে। বেশির ভাগ শিল্প আগের অবস্থানে ফিরে যেতে আরও অনেক বেশি সময় নেবে। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজের মতে, এখনকার সংকটটি আর পাঁচটি সাধারণ অর্থনৈতিক সংকট নয়।

এটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একটি অর্থনীতির জন্য পণ্য ও সেবার পরিমাণ নির্ধারণের বিষয় নয়। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘যাঁরা সংকটের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন, তাঁদের জন্য সামনে আমাদের বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে। এটিকে আপনি হেলিকপ্টার মানি (কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন সরাসরি ব্যক্তিকে টাকা দিয়ে থাকে) বলতে পারেন।’

আইএমএফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি অন্য সংকটের মতো নয়। মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর এর প্রভাব নিয়ে যথেষ্ট অনিশ্চয়তা রয়েছে। অনেক কিছুই ভাইরাসের সংক্রমণের মাত্রা, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কার্যকারিতা, চিকিৎসা ও ভ্যাকসিনের বিকাশের ওপর নির্ভর করছে, যার সবই অনুমান করা শক্ত। অনেক দেশ এখন একাধিক সংকটের মুখোমুখি—যেমন স্বাস্থ্য সংকট, আর্থিক সংকট এবং পণ্যমূল্যের পতন, যা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে। অবশ্য নীতিনির্ধারকেরা জনগণ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও আর্থিক বাজারকে অভূতপূর্ব সমর্থন সরবরাহ করছেন। এটি পুনরুদ্ধারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আইএমএফের পূর্বাভাস বলছে, চলতি বছর বিশ্ব অর্থনীতি ৩ শতাংশ সংকুচিত হবে, যা ২০০৯ সালের মন্দার সময় শূন্য দশমিক ১ শতাংশ সংকুচিত হয়েছিল। মহামারির কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী জিডিপির লোকসান প্রায় ৯ ট্রিলিয়ন ডলার হতে পারে, যা জাপান ও জার্মানির মতো অর্থনীতির চেয়ে বেশিও।

জিরোআওয়ার২৪/এমএ

এই বিভাগের আরও খবর