img

নব্বই দশকের শেষ দিকে এক বর্ষণমুখর সকালে আমরা যাত্রা শুরু করলাম হ‌ুমায়ূন আহমেদের গ্রামের বাড়ি কুতুবপুরের উদ্দেশে। বর্ষাকাল। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি ঝরছে। কুতুবপুর যাওয়ার উদ্দেশ্য, নাটক নির্মাণ ও বর্ষার ঝিল্লিমুখর গ্রামের প্রকৃতি দর্শন। হ‌ুমায়ূন ভাই ‘অদেখা ভুবন’ নামে কয়েকটি গল্প নিয়ে নাটক বানাবেন। প্রতিটি গল্পের আলাদা নাম। আট দিনের সফর। হ‌ুমায়ূন ভাই অভিভাবক, আমরা তাঁর অনুসারী। অভিনেতাদের মধ্যে এই মুহূর্তে যাঁদের নাম মনে পড়ছে, তাঁরা হলেন সালেহ আহমেদ, মাহফুজ আহমেদ, ডা. এজাজুল ইসলাম, শামীমা নাজনীন, মিতা নূর, তাজিন আহমেদসহ আরও অনেকে। অভিনেতাদের বাইরে ছিলেন হ‌ুমায়ূন আহমেদের সর্বকনিষ্ঠ ভাই আমার বন্ধু কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব। সারা দিন বাসের মধ্যে হইহল্লা করে সময়টা ভালো কাটল। এর মধ্যে একবার যাত্রাবিরতি হলো দুপুরের খাওয়ার জন্য। ময়মনসিংহ শহরে একটি হোটেলের সামনে বাস থামানো হলো। আমরা খাওয়াদাওয়া করে আবার বাসে উঠলাম। বাসের মধ্যে আবার গল্প। আবার আড্ডা। অভিনেতা সালেহ ভাই মজার মজার কৌতুক বলে আমাদের বাস জার্নিকে আরও আনন্দঘন করে তুললেন। একসময় হ‌ুমায়ূন ভাইও আমাদের সঙ্গে আড্ডায় যোগ দিলেন এবং তাঁর জীবনের আনন্দ–বেদনার গল্প বলতে লাগলেন। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া সেসব ঘটনা শুনতে লাগলাম। বাইরে তখনো অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। আর আমরা বাসের মধ্যে মোহাবিষ্ট হয়ে একজন জাদুকর লেখকের জীবনকথা শুনছি।

বৃষ্টির কারণে বাস চলছে ধীরগতিতে। আমাদের কারও সেদিক খেয়াল নেই। আমরা হ‌ুমায়ূন ভাইকে ঘিরে তাঁর গল্প শুনছি। একসময় বাসটি জোরে ব্রেক কষে থেমে গেল। ড্রাইভার কোনো কথা না বলে বাস থেকে নেমে গেল। আমরা কিছু না বুঝে চুপচাপ বাসের মধ্যে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর ড্রাইভার বাসে উঠে বলল, স্যার, আমরা কেন্দুয়া আইয়া পড়ছি। ডাইনে কুতুবপুর যাওনের কাঁচা মাটির রাস্তা। বাস যাইতো না। বিষ্টির নিগা রাস্তায় প্যাক কাদা। বাসের চাক্কা ডাইবা যাবো। আফনেরা নামেন। বাকি পথ হাঁইটা যাওন লাগবো। ড্রাইভারের কথা শুনে হ‌ুমায়ূন ভাই সবাইকে বাস থেকে নামতে বললেন। আমরা যার যার লাগেজ নিয়ে বাস থেকে নেমে পড়লাম। আমি হ‌ুমায়ূন ভাইকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই এখান থেকে কুতুবপুর কত দূর? হ‌ুমায়ূন ভাই মৃদু হেঁসে বললেন, বেশি না, পাঁচ মাইলের মতো হবে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। যত দূর চোখ যায় রাস্তায় শুধু কাদা আর পানি। মনে মনে ভাবলাম, এই বিশাল লাগেজ কাঁধে নিয়ে পানি–কাদার মধ্যে আমি এত দূরের পথ কীভাবে যাব! ততক্ষণে হ‌ুমায়ূন ভাই তাঁর লাগেজ নিয়ে হাঁটা শুরু করে দিয়েছেন। আমরাও দেরি না করে নাটকের বিশাল লটবহর নিয়ে তাঁর পিছু নিলাম। এখন বৃষ্টি পড়ছে গুঁড়িগুঁড়ি। সেই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যেই আমরা হাঁটছি। আমাদের চাঙা রাখার জন্য হ‌ুমায়ূন ভাই বিভিন্ন ধরনের গল্প বলতে লাগলেন। তাঁর ছোটবেলার গল্প, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, ভূতের গল্প ইত্যাদি। যখন আমরা হ‌ুমায়ূন ভাইয়ের পৈতৃক বাড়ি পৌঁছালাম, তখন সন্ধ্যা। আমাদের সারা শরীর কাদা–পানিতে মাখামাখি। কেউ কাউকে চিনতে পারছি না এমন অবস্থা। ঠান্ডায় আমার শরীর কাঁপছে। বাড়ির উঠানে পৌঁছানো মাত্র ইসলাম উদ্দিন বয়াতি তাঁর বাবরি চুল দুলিয়ে দরাজ গলায় গান ধরলেন। হ‌ুমায়ূন আহমেদকে বরণ করার গান। গানের কথা অনেকটা এই রকম, ‘তোরা কই গেলিরে হেনা আর মিনা, তাড়াতাড়ি দেখ আইয়া। কতুবপুরের ভাইছাব আইছে ভাবিরে লইয়া।‘ সারা দিনের ক্লান্তি আর ক্ষুধায় তখন আমি চোখে সরষে ফুল দেখছি। কোনো কিছু আর মাথায় ঢুকছে না। হ‌ুমায়ূন ভাইয়ের চেহারায় কোনো ক্লান্তি নেই। প্রাণশক্তিতে ভরপুর। তিনি সবাইকে ইশারায় উঠানের চারপাশে বসতে বললেন। আমরা সবাই বয়াতিকে ঘিরে কাদার মধ্যে বসে পড়লাম। গানে গানে হ‌ুমায়ূন ভাইকে বরণ করা হলো। সেই সঙ্গে জলচৌকিতে দাঁড় করিয়ে তাঁর পা ধুইয়ে দেওয়া হলো। গায়ে ফুলের পাপড়ি ছিটানো হলো। গলায় পরানো হলো গোলাপ ফুলের মালা। অভূতপূর্ব এই দৃশ্য দেখে আমার ক্লান্তি আর ক্ষুধাভাব কেটে গেল। আমি মনের মধ্যে উৎসাহ বোধ করলাম।

বরণপর্ব শেষ হলে আমরা বাড়ির সামনের পুকুরে সবাই মিলে ঝাঁপ দিলাম। গোসল সেরে পরিষ্কার কাপড়জামা পরে একদম ফিটফাট। এবার খাওয়ার পালা। খাবারের বিশাল আয়োজন। বিলের সব ধরনের মাছ। পাবদা, পুঁটি, কই, মাগুর, শিং, বোয়াল, চিংড়ি। কয়েকটি মাছের চেহারা আমি জীবনেও দেখিনি। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা। দেরি না করে তাড়াতাড়ি খাওয়া শুরু করলাম। সব ধরনের মাছ আমি এক পিস করে খেলাম। খাওয়াদাওয়া শেষ। এবার ঘুমানোর পালা। সারা দিনের ক্লান্তিতে ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। এমন সময় আবার ঝুম বৃষ্টি। হ‌ুমায়ূন ভাই ঘরে বসে ছিলেন। তিনি বৃষ্টির শব্দ শুনে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। বৃষ্টির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর তাঁর অ্যাসিসটেন্স জীবনকে ডাকলেন। জীবন এসে পাশে দাঁড়াল। তিনি জীবনকে বললেন, উঠানে একটা ছোট খাট পেতে আমার শোয়ার ব্যবস্থা করো। জীবন অবাক হয়ে বলল, স্যার, বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। কাঁথা, বালিশ, তোশক, চাদর সব ভিজে যাবে। আপনিও ভিজে যাবেন। হ‌ুমায়ূন ভাই তীক্ষ্ণ চোখে জীবনের দিকে তাকালেন। তারপর ক্ষীণ স্বরে বললেন, যা বলি তা–ই করো। বলেই তিনি উঠানের পাশে একটি বাতাবি লেবুগাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালেন। হ্যাজাকের আলোয় আমি স্পষ্ট দেখলাম হ‌ুমায়ূন ভাই গভীর মমতায় লেবুপাতা নাকের সামনে এনে গন্ধ শুঁকছেন। উঠানে শোয়ার ব্যবস্থা রেডি। তিনি আস্তে আস্তে খাটে গিয়ে বসলেন। তারপর আকাশমুখী হয়ে শুয়ে পড়লেন। অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। মুহূর্তের মধ্যে তিনি ভিজে একাকার।

হ‌ুমায়ূন আহমেদ দুহাত ওপরে তুলে হাতের তালুতে বৃষ্টি ধরছেন। বৃষ্টির পানি মুখে মাখছেন। শরীরে মাখছেন। গভীর ভালোবাসায় তিনি বৃষ্টিকে আলিঙ্গন করছেন। এভাবে তিনি বৃষ্টির মধ্যে প্রায় এক ঘণ্টা শুয়ে রইলেন। একসময় বৃষ্টি কমে এলে তিনি বিছানা থেকে উঠে শোয়ার ঘরে চলে গেলেন। আমি মনে মনে ভাবলাম, আহারে ভালোবাসা! বৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা, জোছনার প্রতি ভালোবাসা, গাছ, পাতা, লতাগুল্মের প্রতি ভালোবাসা। একেই বলে প্রকৃতিপ্রেম। আজ করোনাকালে হ‌ুমায়ূন আহমেদ যদি বেঁচে থাকতেন, তিনিও হয়তো বলতেন, এই দুর্যোগ-মহামারি মানুষের ওপর প্রকৃতির প্রতিশোধ। হে মানুষ! তোমরা প্রকৃতিকে ধ্বংস কোরো না। প্রকৃতিকে ভালোবাসো। গাছ, ফুল, বৃক্ষরাজিকে ভালোবাসো। প্রকৃতিও তোমাদের আলিঙ্গন করবে। তোমরা জোছনাবিলাসী হও। বৃষ্টিবিলাসী হও। হঠাৎ গানের সুরে আমার ভাবনায় ছেদ পড়ল।

জিরোআওয়ার২৪/এমএ

এই বিভাগের আরও খবর